শেষের পাতা

ছিন্নমূল কিশোরীর তথ্যে ‘ক্লু-লেস দস্যুতা’র রহস্য উন্মোচন ট্যুরিস্ট পুলিশের

মিজানুর রহমান, কক্সবাজার থেকে ফিরে

২৮ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

ট্যুরিস্ট পুলিশ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ক’দিন হয়। তার আগে তাদের তদন্তের অধিকার ছিল না। মূলত পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়াই তাদের কাজ। তারা এটি করে চলেছেন। কিন্তু পর্যটন এলাকায় ছিনতাই-রাহাজানি কিংবা খুনের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে মামলাটি কোথায় হবে- থানায় না ট্যুরিস্ট পুলিশে? তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে এখনও। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় ডিশোল্ডারিং বা দায়িত্ব এড়ানোর অভিযোগও আছে। বিশেষ করে ব্যবস্থাগ্রহণ প্রশ্নে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। মামলা যেখানেই হোক পুলিশ চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পারে। ঘটনাটি ১৫ই নভেম্বরের। সদর থানায় দায়ের করা এজাহার মতে, ঘটনার সময় সকাল ৮ টা। স্থান লাবনী বিচ মোড়। শরীয়তপুর জেলার ৩ জন বাসিন্দা সারারাত বাস জার্নি করে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার পৌঁছান। লাবনী পয়েন্টে নেমে তারা পাশের এক রেস্টুরেন্টে  নাস্তা সেরে সুগন্ধা পয়েন্টে যাওয়ার জন্য টমটম খ্যাত অটোরিকশায় চড়েন। টার্গেট লাবনী বিচ পয়েন্ট ধরে সুগন্ধা পয়েন্ট যাওয়া। কিন্তু বিধি বাম। টমটম লাবনী  মোড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে পিছু  নেয় নম্বরবিহীন অনটেস্ট লেখা একটি সিএনজি অটোরিকশা। সামান্য অগ্রসর হওয়ার পর ওভারটেক করে খানিকটা চাপা দিয়ে তাদের গতিরোধ করে। সিএনজি অটোরিকশা  থেকে নামে চার যুবক। কোন কথাবার্তা ছাড়াই তারা টমটমে বসা পর্যটকদের গলায় ধারালো ছুরি ধরে। একজনকে আঘাতও করে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে টাকা-পয়সা  মোবাইলফোন সহ সবকিছু নিয়ে চম্পট  দেয়। আহত পর্যটকত্রয় স্থানীয় কক্সবাজার হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। পরবর্তীতে সদর থানায় মামলা করে। যার নম্বর  ৩৬/৪৮২ তারিখ ১৫-১১-২০২০ খ্রি.। ধারা-দণ্ডবিধির ৩৯৪। পুলিশের ভাষ্য মতে, পর্যটকরা জখমি অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে থানায় আসে। অজ্ঞাতনামা ৪  আসামির বিরুদ্ধে তারা মামলা করে। মামলার এজাহারে আসামিদের কোনো বর্ণনা বা তদন্তের জন্য সহায়ক কোনো ক্লু ছিল না। ঘটনাটি যেহেতু পর্যটন সংশ্লিষ্ট তাই তদন্তের দায়িত্ব পায় ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোন অফিস। মূলত ট্যুরিস্ট পুলিশের এটিই প্রথম তদন্ত কাজ। মামলা মনিটরিংয়ে রাখেন পুলিশ সুপার ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়ন জিল্লুর রহমান। আর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সাব-ইন্সপেক্টর প্রীতেশ তালুকদারকে। প্রীতেশ অনেক দিন কাজ করেছেন সিআইডি হেড  কোয়ার্টারে। চাঞ্চল্যকার বহু মামলার তদন্ত করেছেন। প্রখ্যাত পুলিশ অফিসার আব্দুল কাহার আখন্দের ভাবশিষ্য তিনি। তার আগে প্রায় ১০ বছর ছিলেন সিলেটে। ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করেছেন  গানম্যান হিসেবে। বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশে তার বদলির পর এটি তার হাতে আসা প্রথম মামলা হওয়ার বাড়তি চ্যালেঞ্জ ছিল। তাছাড়া মামলাটি তো একেবারেই ক্লু-লেস। যেমনটা বলছিলেন প্রীতেশ তালুকদার এবং অন্যরা। এক রাতে সুগন্ধা বিচ সংলগ্ন তার অফিসে বসে কথা হয়। শীতের রাত, তাতে কী, বিচ এলাকা তখনও উষ্ণ-সরগরম। প্রীতেশ তালুকদারের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল না। পরিচয়টা অনেকটা কাকতালীয়। একটি সিএনজিকে সিগন্যাল দিয়ে কি যেন জিজ্ঞাসা করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত ওই অফিসার। রাত তখন ১২টা প্রায়। পুলিশ কি করছে তা  দেখার চেষ্টা করলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে যে যার পথে। ক’কদম এগিয়ে ওয়াকিটকি হাতে থাকা পুলিশ সদস্যের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তখন তিনি আমাকেও খানিকটা জেরা করেন, কি  দেখছি, কিছু বলবো কি-না? ইত্যাদি। জবাবে বললাম, না, এমনিতেই। পাল্টা প্রশ্ন কি দেখছেন তাহলে? আপনাদের পরিচয়? ইত্যাদি। আমি কথা না বাড়িয়ে পরিচয় প্রকাশ করলাম। বাড়িঘর জিজ্ঞাসা-পর্ব  শেষে বসলাম পাশে থাকা তার অফিস অর্থাৎ সুগন্ধ্যা বিচের প্রবেশমুখে থাকা পুলিশ বক্সে। পুলিশিং প্রশ্নে তার খানিক কষ্টকর স্মৃতিচারণ দিয়ে আলোচনা শুরু। সাংবাদিককূলকে তিনি চিনেন। একে একে অনেকের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বিশেষত ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের। কথা প্রসঙ্গ বললেন উপরোল্লিখিত ছিনতাইয়ের তদন্তভার গ্রহণের কথা। প্রীতেশ তখন বলছিলেন দস্যুতার পুরোপুরি রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি। শুক্রবার এক বার্তায় তিনি সেই ঘটনার বিস্তারিত জানালেন। ঘটনার বিবরণ তিনি তার ফেসবুকেও প্রকাশ করেছেন। অবশ্য তিনি এজন্য গোটা পুলিশ বিভাগকে  ক্রেডিট দিয়েছেন। তার বর্ণনাটি ছিল এমন ‘আমি তদন্তভার গ্রহণ করে ঘটনাস্থল এবং আশেপাশে  একাধিক বার অবস্থান করে তথ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করি। কিন্তু কোনো ধরনের ক্লু পাচ্ছিলাম না। একদিন এক কিশোরী হকারকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলে আমি দেখছি যে স্যার। ‘হেতার সিএনজি’র মধ্যে সাগর দেলোয়ার লেখা ছিল যে’ (কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষা) আমি সাগর আর দেলোয়ার এই দু’টি নাম নিয়ে সামনে এগুতে থাকি।

প্রথমে ঘটনার তারিখ ও সময়ের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লষণ করি। এমন সময় চোখে পড়লো কল্লোল হোটেলের সামনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। সকাল ৮টার দিকের ঘটনা। একটি যাত্রীবাহী  সিএনজি লাবনী পয়েন্ট থেকে লাবনী বিচ পয়েন্টে গিয়ে মোড় নিয়ে লাবনীর মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে সাগর ও  দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজ লেখা। ভাবলাম ছিনতাইকারী পেয়ে গেছি! কিন্তু হায়, সিএনজি’র কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেই। কক্সবাজার শহরে আনুমানিক ৮ হাজার সিএনজি ঢোকে তা থেকে সাগর ও  দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজ সিএনজি বের করা  সহজ কাজ ছিল না। সিসি ক্যামেরা থেকে স্কিন শর্ট নিলাম। জেলার প্রত্যেক সিএনজি লাইনম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। কিন্তু  কেউ কোনো তথ্য দিতে পারল না। এক সময় নজরে এলো  সিএনজি’র পিছনে ছোট্ট করে অস্পষ্টভাবে জিয়া আর্ট লেখা। গেলাম জিয়ার কাছে। সে বলছে এইটা আমার আর্ট, তবে কার গাড়ি মনে নেই। তবে সে এটুকু বলছিলো- গাড়িটি রাস্তার মোড় পাড়ার দিকের হবে। ওই তথ্যে ক্লু আস্তে আস্তে আরও স্পষ্ট হতে থাকলো এবং রহস্যের কাছাকাছি এগোতে থাকলাম। তারপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে  বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাতভর চেষ্টা চলে সিএনজি ধরার। এএসআই ক্ষিরদ অবশ্য কনকনে শীতের রাতে অনেক কষ্ট করেছেন। উভয়ের চেষ্টায় পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে রুহলার ডেইল গ্রামের আমিনুল ইসলামের ছেলে সাগরকে ২৫শে নভেম্বর  ভোরে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। তার দেখানো মতে সিএনজি জব্দ করি এবং পরবর্তীতে  ছিনতাইকারী নুরুল ইসলাম সেলিম, পিতা আলতাজ মিয়া, গ্রাম জানার ঘোনাকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হই। তাদেরকে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করি। তারা দুইজনেই  ছিনতাইয়ের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সহকারে ১৬৪ ধারা মোতাবেক আদালতে  স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। প্রীতেশ তার ফেসবুকে লিখেন- ‘আসামি শনাক্ত, তবে তদন্ত এখনও অব্যাহত রয়েছে। অতি. পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার মহোদয় নির্দেশনা দিচ্ছেন, তদারকি করছেন। কক্সবাজারে ছিনতাইকারীদের শিকড় উপড়ে  ফেলা এবং পর্যটকদের জন্য একটি ছিনতাইমুক্ত সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে আমরা বদ্ধপরিকর ।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status