মত-মতান্তর

ভেপিং নিষিদ্ধ করার দাবি কতটা যৌক্তিক ?

অধ্যাপক ডা: মিথুন আলমগীর

২৬ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:২০ পূর্বাহ্ন

ধূমপান ছাড়ার উপায় নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষকেরা বিভিন্ন উপায় বেরও করেছেন। দীর্ঘদিনের অভ্যাস এর সাথে শারীরিক ও মানসিক বিষয়ও যেহেতু জড়িত এ কারণে অধিকাংশ ধূমপায়ী সদিচ্ছা থাকলেও হুট করে ধূমপান ছেড়ে দিতে পারেন না। বরং তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে দিলে পরে আবার সেই আসক্তি ফিরে আসে বেশ জোর দিয়ে। গবেষকেরা এ বিষয়টি নজরে রেখেই কিছু উপায় বের করেছেন, যার একটি ভেপিং। পণ্যটি অধূমপায়ীদের জন্য নয়, বরং যারা ধূমপায়ী তারা নিকোটিনের মাত্রাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন সিগারেট। কারণ ভেপিংয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় নিকোটিন। আর সিগারেটের চেয়ে এর ক্ষতির পরিমাণ ৯৫ শতাংশ কম। আর এতে নেই পরোক্ষভাবে কারো ক্ষতির আশঙ্কা।  তবে ভেপিংয়ের সমালোচকেরা বিষয়টি আমলে না নিয়ে বা এর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য না নিয়ে সমালোচনা বা বিরোধীতা করছেন বলে মনে হচ্ছে। পাশ্চাত্যে ভেপিংয়ের মাধ্যমে ধূমপান ছেড়ে দিচ্ছেন বহু মানুষ। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ অবহিত না হয়ে বিধি নিষেধ আরোপ করলে ঝুঁকিতে পড়ে যাবে ধূমপান ছাড়তে চাওয়া মানুষগুলোই। আবার প্রচলিত ধূমপানে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা। ভেপিং সংক্রান্ত গবেষণাগুলোতে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কার্যকর উপায় হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে ই-সিগারেট। যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ড তাদের ২০১৫ সালের গবেষণায় দেখেছে, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ভেপিং ৯৫ ভাগ কম ক্ষতিকর। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ধূমপান ছাড়ার জন্য ভেপিংয়ের পরামর্শ দিচ্ছে। এই গবেষণার ফলকে ‘যুগান্তকারী’হিসেবে বর্ণনা করছে সংস্থাটি। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যখাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গবেষেণার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ধূমপান ছাড়ার জন্য ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের দোকানগুলোতে ই-সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। ২০১৯ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে ভেপিংয়ের সাহায্য নিয়ে বছরে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মানুষ ধূমপান ছাড়তে সফল হচ্ছেন। বিজ্ঞান-সাময়িকী ’অ্যাডিকশন’-এর এক নিবন্ধে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যে ৫০ হাজার ৭০০ থেকে ৬৯ হাজার ৯৩০ ধূমপায়ী ভেপিংয়ের সহায়তায় ধূমপান ছেড়েছেন। ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে ই-সিগারেট ব্যবহারে বিশ্বের সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর পরামর্শ কী বার্তা দেয়? বাংলাদেশ এই পরামর্শ থেকে কী বার্তা পেতে পারে? যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশেও তামাক এবং তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার হ্রাসের ক্ষেত্রে, ধূমপানের হার হ্রাসের ক্ষেত্রে কার্যকর উপায় হতে পারে ভেপিং। কারণ, বাস্তবে এর সহায়ক ভূমিকা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। ভেপিংয়ের কার্যকারিতা যাচাইয়ে যুক্তরাজ্যে মানবদেহে পরীক্ষা (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) চালানো হয়েছিল গেল বছর। এতে দেখা যায়, ধূমপান ছাড়ার উপায় হিসেবে নিকোটিনযুক্ত প্যাচ বা চুইংগামের তুলনায় ই-সিগারেট দ্বিগুণ কার্যকর। ভেপিংয়ের সফল, নিরাপদ এবং কার্যকর ব্যবহারের জন্য যথাযথ কৌশল প্রণয়ন জরুরি, যা একটি সুস্থ জাতি গঠনে সহায়ক হবে। ভেপিং নিষিদ্ধ করে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বা ছাড়াতে আগ্রহীদের পুনরায় ধূমপানের দিকে ঠেলে দেওয়া কোনো সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস তাদের ওয়েবসাইটে সতর্ক করছে, ভেপিং সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়, তবে প্রচলিত সিগারেট তুলনায় ঝুঁকির পরিমাণ সামান্য। ধূমপান ছাড়তে কোনো বিশেষজ্ঞের সরাসরি পরামর্শ এবং ই-সিগারেট ব্যবহার যুগপৎভাবে চললে সফল হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি । পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ডও মানছে, ভেপিং সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়, তবে ক্যানসারের অন্যকম কারণ তামাকজাত সিগারেটের তুলনায় ভেপিংয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৯৫ ভাগ কম। গবেষণাগুলো আমলে না নিয়ে অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভেপিং নিষিদ্ধ করা হলে নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অনেকে পুরোনো ধূমপানে ফের ঝুঁকে পড়বেন। দেশে তামাক এবং তামাকজাত পণ্যের কারণে সৃষ্ট সমস্যা অনুধাবন করতে হবে নীতি-নির্ধারকদের। এই সংকট নিরসণে তাদের কাছে থেকে সুবিবেচনাপ্রসূত কৌশল এবং কর্মপন্থা প্রত্যাশিত। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত গবেষণা ফলাফলে ভেপিংয়ের এমন ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি, বরং ধূমপান থেকে সরে আসতে এর ইতিবাচক ভূমিকা দেখা গেছে। তাই দেশের ধূমপায়ীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যের তথ্যনির্ভর, ইতিবাচক ভূমিকাই কাম্য। আর ভেপিং নিষিদ্ধ করা হলে এর বিপণন ও বিক্রয় কালোবাজারের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এতে করে ভোক্তাদের অনিরাপদ এবং নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য করা হবে যা আরও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।  

লেখক: এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status