অনলাইন

খোদ সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জায়নবাদের এজেন্ট!

মেইর জামির

২২ নভেম্বর ২০২০, রবিবার, ৩:২৪ পূর্বাহ্ন

১৯৪৫ সালে নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের ফরাসি কর্মকর্তাদের কাছে সিরিয়া ও লেবাননজুড়ে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিটি ছিলেন জামিল মারদাম। সিরিয়ায় তখন ফরাসিদের ম্যান্ডেট জারি। তাদের ম্যান্ডেটে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মারদাম। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য ছিল যে, মারদাম বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর প্রধান ইলটিড নিকল ক্লেটন ও ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নূরী সাদের হয়ে কাজ করছেন। ফরাসিদের কাছে আরও তথ্য ছিল যে, ফরাসিরা সিরিয়া থেকে সরে যাওয়ার পর ইরাক ও হাশেমি রাজপরিবারের শাসনাধীন ট্রান্স-জর্ডানে সিরিয়ার যোগদান বিষয়ক একটি পরিকল্পনায় মারদামেরও সম্মতি রয়েছে।  ইরাক ও ট্রান্সজর্ডান তখন বৃটেনের নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়া ওই দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিলে এই দেশটির ওপর বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। ওই পরিকল্পনাকে ‘গ্রেটার সিরিয়া’ বা বৃহত্তর সিরিয়া পরিকল্পনা হিসেবে ডাকা হয়। পরিকল্পনাটিতে ভূমিকা রাখার জন্য মারদাম মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়েছিলেন ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হাশেমি রাজতন্ত্রের অধীনে তিনি নিজেই সিরিয়া শাসন করবেন তিনি।

ওই গোয়েন্দা তথ্য নাটকীয়— ও ইতিপূর্বে অজানা—কয়েকটি পর্বের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে বর্তমানের রূপদানে বড় ভূমিকা রেখেছে। ফরাসিরা গ্রেটার সিরিয়া পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর ওই পরিস্থিতিকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তারা মারদামকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। ওই তথ্য সম্বলিত নথিপত্র প্রকাশ করে দেওয়া ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেয়। মারদাম অবশ্য ১৯৪৫ সালের আগস্টে তার বৃটিশ কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। কিন্তু বৃটিশরা তখন জানতো না যে, মারদান ততদিনে ডাবল এজেন্ট হয়ে উঠেছেন। ফরাসিদের ব্ল্যাকমেইলের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ তখন অনিশ্চয়তায় ঝুলছিল। আর সে সময়ে মারদাম বৃটিশ সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা, ইচ্ছা ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফরাসিদের সরবরাহ করছিলেন।

কিন্তু এই গল্প সেখানেই শেষ হয়নি। ফরাসি ও ইসরাইলি আর্কাইভে গবেষণা চালিয়ে ও সিরিয়ার সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মারদাম আসলে কেবল ফরাসিদের হয়েই কাজ করেননি। তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল জায়নবাদী (জায়নিস্ট) একটি গোয়েন্দা সংস্থাও। মারদামের সরবরাহ করা তথ্য, ১৯৪৫ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত দেশটির জনক ডেভিড বেন-গুরিয়নের কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

এ সবকিছুর শুরু হয় ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে। ফরাসিদের সামনে তখন নতুন এক সমস্যা হাজির হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা ছাড়ার পর মারদাম মিসরে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত ও মিসরের রাজধানী কায়রোতে আরবলীগের সদরদপ্তরে সিরিয় দূত হিসেবে নিযুক্ত হন। সন্দেহ না জাগিয়ে সেখানে মারদামকে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ছিল ফ্রান্সের জন্য। এ সমস্যার সমাধানের জন্য সেখানে এলিয়াহু সাসনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দায়িত্ব ছিল, মারদামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ফরাসিদের কাছে সরবরাহ করা।

সাসন ছিলেন তৎকালীন জুয়িশ এজেন্সি’র রাজনৈতিক বিভাগের আরব শাখার  প্রধান। জুয়িশ এজেন্সি হলো বিশ্ব জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের একটি শাখা, যেটি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ফরাসি গোয়েন্দাদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতেই তাকে সেখানে নিয়োগ দিয়েছিলেন এজেন্সি প্রধান বেন-গুরিয়ন। সাসন ছিলেন সিরিয়-বংশোদ্ভূত। মারদামের সঙ্গে আগ থেকে পরিচয় ছিল। মারদাম প্রথম দফায় সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার অল্প সময় পর ১৯৩৭ সালে তাদের দেখা হয়েছিল। ফরাসিদেরও সাসনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযান পরিচালনায় সক্ষমতার বিচারে ফরাসিদের কাছে সাসনের মূল্যায়ন ছিল উচ্চ পর্যায়ের। মারদামকে সামলাতে বছরের শেষের দিকে ফরাসিরা তার সঙ্গে কাজ শুরু করে।

নথিপত্র অনুসারে, ১৯৪৫ সালের ১২ই নভেম্বর মারদামের সঙ্গে কায়রোতে দেখা করেন সাসন। ছয়দিন পর আবার দেখা হয় তাদের। মারদাম তখন আরব লীগে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধির ব্যবস্থা করতে লীগের একটি প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে জেরুজালেম সফরে গিয়েছিলেন। মারদামের সঙ্গে দুই দফা দেখার পর ২২শে নভেম্বর সাসনের দেখা হয় বেন-গুরিয়নের সাথে। মারদামের সঙ্গে জুয়িশ এজেন্সির আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা একটি ডায়রিতে লিপিবদ্ধ পাওয়া গেছে। এরকম গুটিকয়েক ঘটনায় বেন-গুরিয়নের সরাসরি গোয়েন্দা সূত্র হিসেবে মারদামের পরিচয় নিশ্চিত হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে মারদামের গুপ্তচর পরিচয় ফাঁস হওয়া থেকে রক্ষা করে চলেন সাসন ও ফরাসি গোয়েন্দারা।

তবে ‘ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্সেস’-এর সদরদপ্তর বৈরুতে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ডায়েরিতে বেন-গুরিয়নের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে মারদামের পরিচয় আরো নিশ্চিত হওয়া যায়। ওই ফরাসি গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম মরিস ফিশার। ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্সেসের সদরদপ্তরে কাজ করার আগে ইহুদি প্যারামিলিটারি সংস্থা হাগানাহ-র হয়ে কাজ করেছিলেন ফিশার। পরবর্তীতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্সে দেশটির প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ফিশার তার ডায়েরিতে লিখেন, কাইরোর জায়নিস্ট এজেন্টদের কাছে কথিত গ্রেটার সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করতে অ্যাংলো-ইরাকি গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করেছিলেন মারদাম।

জায়নিস্টদের কাছে মারদামের গুরুত্বের পক্ষে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় নাহুম উইলেনস্কি নামের এক জুয়িশ এজেন্সি কর্মকর্তার প্রতিবেদনে। তিনি ফিশার ও জুয়িশ এজেন্সির রাজনৈতিক বিভাগের মধ্যে লিয়াজু হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে লেখা এক প্রতিবেদনে উইলেনস্কি লিখেন, অন্যান্য বহু আইটেমের পাশাপাশি ফরাসিদের কাছে কিছু নথিপত্র রয়েছে যেগুলোতে প্রমাণ রয়েছে যে, বহু সিরিয় নেতা বৃটিশদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন। ফরাসিরা ওই নথিপত্রগুলো প্রকাশের জন্য সুযোগ্য সময়ের অপেক্ষা করছে। আর এ সময়ের মধ্যে, ওই নথিপত্রগুলো ব্যবহার করে সেখানে উল্লেখিত সিরিয় নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ওই নেতাদের তালিকার শুরুতেই ছিল মারদামের নাম।

বেন-গুরিয়ন আশঙ্কা করছিলেন ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আরব রাষ্ট্রগুলো হামলা চালাতে পারে। এজন্য ১৯৪৫ সাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু মারদামের দেওয়া তথ্য তার নজর ভিন্নদিকে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন আরব রাষ্ট্রগুলোর হামলা নয়, বৃটিশ সামরিক কমান্ডার ও মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরিকল্পনাই ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, তারা নানাভাবে ইহুদিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করছিল। এসব পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, হাগানাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া ও অস্ত্রহীন করে দেওয়া। আরও ছিল, গ্রেটার সিরিয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, যার আওতায় ম্যান্ডাটরি ফিলিস্তিনের অধীনে একটি সীমিত ইহুদি সত্তা গঠন করা হবে, কোনো স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র নয়। জানা যায়, মারদামের দেওয়া তথ্য থেকেই বেন-গুরিয়ন জানতে পারেন যে, জুয়িশ এজেন্সিতে একজন গুপ্তচর ঢুকাতে পেরেছে বৃটিশ গোয়েন্দারা। ওই গুপ্তচর এজেন্সির নেতৃত্বের মধ্যকার গোপন আলোচনার তথ্য বৃটিশদের সরবরাহ করছিল।

মারদামের দেওয়া তথ্যানুসারে, আরব শাসকরা সোভিয়েত হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হলে, তারা বৃটিশদের পক্ষে লড়াই করবেন। এদিকে, বৃটেন তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সময় চাইছিল। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক দৃঢ় করতে চাইছিল তারা। অন্যদিকে, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আরব লীগ পরিষদের উদ্বেগ ছিল যে, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের চলমান অভিবাসন চলতে থাকলে আনুমানিক ৮ লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করার সক্ষমতা অর্জন করবে হানাগাহ। আরব নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তেমনটা হলে ইংলিশদের সহায়তা নিয়েও প্রস্তুতি ও সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে হানাগাহর সঙ্গে তারা কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। আরব নেতারা চাইছিলেন, বৃটিশ সেনাবাহিনী ফিলিস্তিন থেকে না সরুক।

তবে সবশেষে, গ্রেটার সিরিয়া পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন সৌদি আরবের বাদশাহ ইবনে সওদ। তিনি ওই পরিকল্পনাকে তার রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বৃটেনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। এই চাপের মুখে, ১৯৪৬ সালের ১৪ই জুলাই বৃটিশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা গ্রেটার সিরিয়া প্রকল্প সমর্থন করে না। তবে সোভিয়েত হুমকির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে মধ্যপ্রাচ্যে ‘হাশেমি গ্রেটার সিরিয়া’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা জারি রাখে বৃটিশ সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। (চলবে)

(মেইর জামির নেগেভের বেন-গুরিয়ন ইউনিভার্সিটির একজন এমিরেটাস অধ্যাপক। মধ্যপ্রাচ্যে অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ ও ইসরাইল প্রতিষ্ঠা নিয়ে তার একটি বই আগামী বছর প্রকাশিত হবে)

(ইসরাইলি পত্রিকা দ্য হারেৎস থেকে অনূদিত)

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status