অনলাইন

স্বাধীন নাগরিক নাও থাকতে পারেন ট্রাম্প

যেসব কারণে ট্রাম্পের বিচার করতে সকলের হাত-পা বাঁধা

ড. আবেদীন কাদের, নিউজার্সি থেকে

২১ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ৬:৫৭ পূর্বাহ্ন

রাজনীতি নিয়ে কিছু আগাম বলা বোকামি। কারণ একদিন বা এক সপ্তাহ পর রাজনীতিতে কী হবে বলা মুশকিল। কিন্তু কিছু কিছু রাজনৈতিক অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ। মানুষ এতোটাই অপমানিত এবং বিব্রত থাকেন যে যেকোন মূল্যে পরিবর্তন চান।  নির্বাচনের আগে একটি পত্রিকায় আমি লিখেছিলাম, বাইডেন জেতার সম্ভাবনা প্রায় আশি শতাংশ এবং ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা ২৮০ থেকে ২৯০ এবং চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন পপুলার ভোট বেশি পাবেন। আর যদি হেরে যান তাহলে ২৪০ থেকে ২৫০ ইলেকটোরাল ভোট পাবেন, কিন্তু হিলারির মতোই কয়েক মিলিয়ন পপুলার ভোট বেশি পাবেন। আমার কথা মিথ্যা প্রমাণ করে বাইডেন ৩০৬ ইলেকটোরাল ভোট এবং প্রায় ৬ মিলিয়ন বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন।

এখন কথা হল এরপরও ট্রাম্প তার মিথ্যাচারিতা অব্যাহত রেখেছেন। বেআইনি পথে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি ফেডারেল অপরাধ করেছেন মিশিগানের জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তারা নির্বাচন সার্টিফাই না করেন। তারা হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন তারা আইনি পথেই দায়িত্ব পালন করবেন। এভাবে পেনসিলভানিয়া বা অন্যান্য স্টেটেও একই অবস্থা হবে। তাহলে ট্রাম্প কেন এতো মরিয়া হয়ে উঠছেন নাবালক শিশুর মতো ক্ষমতায় থাকার জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ নয়, আবার খুব বেশি জটিলও নয়।

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এক আজব দেশ, অনেকেই মনে করেন এখানে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে, বীমা জালিয়াতি করে, এমনকি কর ফাঁকি দিয়ে, বেনিফিট খেয়ে, ভুয়া নামে বিভিন্ন সরকারী সাহায্য নিয়ে সহজেই পার পাওয়া সম্ভব। হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই সেসব করেছেন। কিন্তু কোথায় সেই ‘করা’ থামাতে হবে সেটা জানতে হবে। এসব করে বহু বাঙালি এখন জেলে। এদেশি এবং বিদেশী অনেকেই জেলে। আসলে ট্রাম্প  এবং তার পরিবার ব্যবসা এবং স্টেট ও ফেডারেল কর দেয়া বিষয়ে কয়েক দশক যাবত এদেশের আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে শত শত মিলিয়ন ডলার বেহাত করেছেন। একের পর এক কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্যাংকের শত শত কোটী টাকা মেরে দিয়েছেন। কিন্তু ভুলটা তার হয়েছে কোথায় থামতে হবে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই এদেশের কর ফাঁকিসহ অনেক সিভিল এবং ক্রিমিনাল মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেসব মামলা তদন্ত শুরু হবে জানুয়ারি ২১, ২০২১ থেকেই।

সেটাই তার মূল সমস্যা নয়, আরেকটি নতুন বড় সমস্যা যোগ হয়েছে গত চার বছরে। সেটা হল বিদেশের কয়েকটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? বিশেষ করে রাশিয়া এবং তুরস্ক,এসব দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পর্কে জনগণের ঘোর সন্দেহ আছে। অভিযোগ আছে যে তার নির্বাচনী প্রচারের তহবিলে বিদেশি দুয়েকটি দেশের উৎস থেকে অর্থ এসেছে, তার মধ্যে তুরস্ক রয়েছে। পুটিনের সংগে তার সাক্ষাৎ এবং আলোচনার নথি সে রাষ্ট্রীয় মহাফেজখানায় জমা দেয়নি। কী কথা হয়েছে তার সঙ্গে, সেখানে দোভাষী বা সেক্রেটারির রেকর্ড জানতে দেয়া হয়নি। এছাড়া আরও কয়েকটি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আছে, যা রাষ্ট্র তদন্ত করবে। সেসবের যেকোন একটি প্রমাণিত হলে সে ট্রেজন বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। এর পরিণাম ভয়াবহ।

হার্ভার্ডের প্রাক্তন আইনের অধ্যাপক, বর্তমানে মার্কিন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন একটি ভয়াবহ উক্তি করেছিলেন, ‘নির্বাচনের পর ট্রাম্প একজন স্বাধীন নাগরিক নাও থাকতে পারেন!’ এই ধরনের মানুষ যাদের কাছে বহু ক্লাসিফায়েড তথ্য রয়েছে, যা তাঁরা জানেন, এর পরিণামও তাঁরা জানেন।

এখন কথা হচ্ছে, মার্কিন সরকার বা জনগণ একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রীয় অপরাধের জন্য জেলে পাঠাবে কিনা, যদি সে আইনের চোখে অপরাধী বিবেচিত হয়। সম্ভবত, সেটা ইতিহাসের জন্য খুব খারাপ নজীর হয়ে থাকবে। যে কারণে ভয়াবহ অপরাধের পরও নিকসনকে ক্ষমা করা হয়েছিল। কিন্তু নিক্সন আর ট্রাম্প সম্ভবত একই রকম অপরাধী নয়। এছাড়া নিক্সনের উত্তরসূরি ছিল একজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের উত্তরসূরি তা নন।

আরেকটি বিষয় মার্কিন রাজনীতিকরা ভাবতে বাধ্য হবেন তাহলো এই মানুষটির মিথ্যাচার এবং রুচিহীনতা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, তার অপরাধের বিচার না হলে যে ৭৩ মিলিয়ন ভোটার তাকে ভোট দিয়েছে, তাদেরকে আগামী চার বছর অবিরাম উসকিয়ে আরও বড় অন্যায়ের দিকে সে নিয়ে যাবে দেশকে। যেটা রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। সে কারণে মার্কিন জনগণ এবং রাজনীতিকদের মনে হয় ট্রাম্পের অপরাধের বিচার করার ব্যাপারে হাত পা অনেকটা বাঁধা। চাইলেই তাকে নিষ্কৃতি দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এছাড়া এবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য স্ট্যাকটা একটু বিশাল।

ট্রাম্পের রাজনীতি এবং বর্তমান মার্কিন গণতন্ত্রের কথা ভাবতে গিয়ে আমার প্রিয় লেখক কার্ল স্মিটের কথাই আমার সবসময় মনে পড়ে। স্মিট বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক এবং শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁর অনেক বইয়ের মধ্যে কয়েকটা বই আজ এক কয়েক দশক যাবৎ পশ্চিমা রাজনীতিক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবায়। সেগুলো হল, Concept Political, The Crisis in Parliamentary Politics, Legality and Legitimacy, Constitutional Theory এবং Political Romanticism. রাষ্ট্র এবং রাজনীতির সূক্ষ্ম ব্যভিচারগুলো বোঝার জন্য এগুলো আকর গ্রন্থ। আমার নিউ স্কুলের অধ্যাপকরা এসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ক্লাসে আলোচনা করতেন, সেটা পরিষ্কার মনে আছে।

আমি স্মিটের রাজনীতির অনুসারী নই, কিন্তু এই কালজয়ী মেধাবী মানুষটির গ্রন্থ পড়ে আজও মুগ্ধ হই। তাঁর মতে রাজনীতিকরা দরবেশ বা সন্ন্যাসীর মতো সৎ দেখতে হলেও কী ভয়াবহ শয়তান হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সেটাই সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা বা আলোচনার বিষয় হওয়া উচিৎ। কার্ল স্মিট হিটলারের নাৎসী পার্টির সমর্থক হওয়ার জন্য ক্ষুরধার আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত হয়েও জেল খেটেছেন, কিন্তু লিখে গেছেন কিছু অমর গ্রন্থ। গণতন্ত্র বা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা শাসনতন্ত্রে খুব সহজ নয়, এর ফাঁকগুলো বন্ধ করা ততোধিক কঠিন। আজ মার্কিন রাজনীতি দেখলে সেটা আরও পরিষ্কার বোঝা যায়! তবে আমার ধারনা, ট্রাম্প চারিত্রিক শটতা, দুরাচার, মিথ্যাচারিতার স্বভাব নিয়েও একটি ফেনমেনন হিশেবে এসেছে মার্কিন রাজনীতিতে, তার অপরাধ প্রমাণিত হলে বিচার অবশ্যই অনিবার্য হয়ে উঠবে এসমাজে! আমার মতে তার রাজনীতির বাইরে সবচেয়ে বড় অপরাধ মার্কিন জনগণের বুদ্ধিকে নিরন্তর অবলীলায় অপমান করে যাওয়া! এতোটা নৈতিক স্খলনের প্রেসিডেন্ট মার্কিন সমাজ কম পেয়েছে আগে!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status