প্রথম পাতা

দ্রুত পরিকল্পনার পরামর্শ, করোনায় মৃত্যু, শনাক্ত বেড়েছে

ভ্যাকসিন সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

২০ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ৯:২৩ পূর্বাহ্ন

ছবিঃ সংগৃহীত

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। ভাইরাসটির কার্যকর ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশেও টিকা পাওয়ার প্রহর গুনছে মানুষ। কবে, কীভাবে এই ভ্যাকসিন মানুষের কাছে পৌঁছাবে এ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। করোনার ভ্যাকসিন সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিতরণের জন্যে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে সরকার। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান ব্যবস্থায় এতো বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন বিতরণ করাই বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মতে, ভ্যাকসিন সংগ্রহের পর তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পাঠাতে হবে। সে সময় একে সঠিক তাপমাত্রায় রাখতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন বিদ্যমান সরবরাহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। কারণ এ পর্যন্ত যতোগুলো ভ্যাকসিনের অগ্রগতি জানা গেছে এসব টিকা সংরক্ষণ করতে হয় ন্যূনতম মাইনাস ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, এতো বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই আগ থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, এই ভ্যাকসিন দ্রুত দিতে হবে। সারা দেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করাটাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। তার মতে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার জন্যে বিশালাকৃতির ‘কোল্ড চেইন’ নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। সেসব ভ্যাকসিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সঠিক নিয়মে পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশে যে ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে স্বল্প সময়ে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা সম্ভব না। শিশুদের টিকা দেয়ার বিষয়ে ইপিআই-এর সক্ষমতা আছে। কিন্তু করোনার টিকা দ্রুত দিতে হবে। যা দশগুণের মতো বেশি। ২শ’ মিলিয়ন ডোজ। সরকারকে আগেই এই ব্যবস্থাটি ভেবে রাখতে হবে। তিনি বলেন, এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখানে অনেক জনবল লাগতে পারে। ভ্যাকসিনে আনতে যত খরচ হবে, তা আবার বিতরণেও খচর কম নয়। তিনি বলেন, উন্নত দেশের জন্যও চ্যালেঞ্জ আছে। তবে তাদের টাকা ও প্রযুক্তি আছে। তাদের সমস্যা কম হবে।

‘কোল্ড চেইন’ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সঠিক তাপমাত্রায় এই জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা মোতাবেক উৎপাদন থেকে শুরু করে মানবদেহে প্রয়োগ পর্যন্ত ভ্যাকসিনকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে গেলে বেশকিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে। সেখানে হিমাঙ্কের নিচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রাখা সম্ভব।

সূত্র বলছে, সরকার আপাতত ফাইজার বা মডার্নার টিকা নিয়ে কম ভাবছে। কারণ এই দু’টি কোম্পানির টিকা যে তাপমাত্রায় পরিবহন ও সংরক্ষণ করতে হবে, সেই ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নেই। এমনকি উপমহাদেশেও নেই। এটা করা অনেক ব্যয়বহুলও। বরং সরকারের এখন সবচেয়ে বেশি নজর অক্সফোর্ড, রাশিয়া, ভারত ও চীনের টিকার দিকে। এগুলোর সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহজ। তবে যদি অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তখন অবশ্যই মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রার কোল্ড চেইনের ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা যতই ব্যয়বহুল হোক না কেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই) ডা. শামসুল হক মানবজমিনকে বলেন, এখন আর আমরা দেরিতে টিকা আসার বিষয়টি মাথায় রাখছি না। বরং ডিসেম্বরের মধ্যেই আসতে পারে, সেদিকে নজর রেখেই নভেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি শেষ করতে চাই। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এজন্য কাজ করা কমিটিগুলো তাদের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো যাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। পাশাপাশি যারা মাঠপর্যায়ে টিকা প্রয়োগ করবেন তাদের করোনার টিকা প্রয়োগের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে কাজ চলছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ইপিআইয়ে যারা আছেন তাদের মাধ্যমেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। সারা দেশে আমাদের ২২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ১৭ হাজার। বাকি ৫ হাজারের মতো পদ শূন্য। যদিও টিকা দেয়ার সময় আরো স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করা হবে; তারাও প্রশিক্ষণ পাবেন। তিনি বলেন, যেসব ভ্যাকসিন আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা যাবে যেগুলোর ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। যেহেতু ডব্লিউএইচও এখনো কোনো ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়নি তাই এর সংরক্ষণ ও সরবরাহ প্রক্রিয়া কী হবে তা জানা যায়নি। শামসুল হক আরো বলেন, বর্তমানে আমরা ৬ ধরনের ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র এক ধরনের ভ্যাকসিন মাইনাস তাপমাত্রায় রাখার প্রয়োজন হয়। দেশের প্রতিটি উপজেলায় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার সক্ষমতা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

গত ৫ই নভেম্বর সরকার ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে। দেশে বিদ্যমান ‘কোল্ড চেইন’ এর কথা বিবেচনায় নিয়ে সিরামের কাছ থেকে ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন নেয়ার কথা সেই স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটিকেই ‘কোভিশিল্ড’ নাম দেয়া হয়েছে। এটি বিভিন্ন দেশে চূড়ান্ত ট্রায়ালে রয়েছে। সমঝোতা স্মারক মতে, দেড় কোটি মানুষের জন্য এই ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে সরবরাহ করা হবে।

ওদিকে গত ৭৮ দিনের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে করোনা রোগী। ধারাবাহিকভাবে গত ৪ দিন ২ হাজারের উপরে শনাক্ত হয়েছে। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সামনে ঝুঁকি আরো বাড়বে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সংক্রমণের গতি কয়েকদিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বেড়েছে।

দেশে সরকারি হিসাব মতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ৩শ’ ছাড়িয়েছে।  শনাক্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৪১ হাজারের বেশি। দেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয় আর প্রথম মৃত্যু ১৮ই মার্চ। প্রথম থেকেই করোনার থাবা ঢাকাতে। হটস্পট ছিল রাজধানী। দিনে দিনে সারা দেশে ছড়ালেও রাজধানীতেই অর্ধেকের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো শিথিল হওয়ায় রাজধানীতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশে গত কয়েদিন ধরে করোনা রোগী শনাক্ত আবারো বেড়েছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। হাঁচি, কাশি হলে রুমাল বা কনুই ব্যবহার করতে  হবে। সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে ভালো করেছে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে চলছে, তাতে ধরেই নেয়া যায় শীতকালে এ ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার প্রকোপ বাড়বে। তার আশঙ্কা শীতকালে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক  ডা. বে-নজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, টেস্ট বাড়ালে রোগী বেড়ে যায়। পরীক্ষা কম হলে শনাক্তও কমে যায়। কয়েকগুণ রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়নি দেশে। বেশকিছু দেশে সংক্রমণ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আমরা কমাতে পারিনি।

নতুন শনাক্ত ২৩৬৪, মৃত্যু ৩০ জন: গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে  জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৬৪ জন। ৭৮ দিনের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ শনাক্ত। গত ২রা সেপ্টেম্বর ২ হাজার ৫৮২ জন শনাক্ত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৪১ হাজার ১৫৯ জন শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৩০ জন এবং এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status