প্রথম পাতা

পানির জন্য হাহাকার

সিলেটে অন্ধকারে লাখো মানুষ

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২০ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

সন্ধ্যা ৬টা। বিদ্যুৎ এলো জিন্দাবাজারে। দেখতে দেখতে আলোকিত হলো বেশির ভাগ এলাকা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মানুষ। ফিরে পেলেন প্রাণশক্তি। বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে মিললো মুক্তি। কিন্তু জিন্দাবাজারের ঠিক পাশেই জল্লারপাড়-তালতলা এলাকা। জিন্দাবাজার আলোকিত হলেও জল্লারপাড়-তালতলা রয়েছে অন্ধকারে। বিদ্যুৎ নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সিলেট নগরীর প্রায় ২০ ভাগ এলাকা এখনো অন্ধকারে। প্রতীক্ষা শুরু। আশায় বুক বেঁধে রাখলো ওই ২০ ভাগ এলাকার মানুষ। হয়তো বিদ্যুৎ আসবে। কিন্তু না বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা বিদ্যুতের দেখা পেলেন না। আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। টানা তিনদিন ধরে পানি নেই সিলেটের বৃহত্তর শেখঘাটের কমপক্ষে ৩০টি এলাকায়। রাতে অপেক্ষার পর বৃহস্পতিবার সকাল হতেই পানির জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন মানুষ। ঘরে থাকা কলসি, বালতি, ড্রাম নিয়ে যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন। বেশির ভাগেরই যাত্রা ছিল সুরমা নদী। শুস্ক মৌসুমে কমে এসেছে সুরমার পানি। এরপরও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সুরমা তীরবর্তী শেখঘাট সহ ২০টি এলাকার মানুষ নদীতেই ছুটছে। একই অবস্থা সিলেটের দক্ষিণ সুরমা অংশেও। দক্ষিণ সুরমার অর্ধশতাধিক এলাকায়ও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুতের দেখা মিলেনি। মানুষ সুরমা নদী থেকে দলবেঁধে পানি সংগ্রহ করছিল। এ এক বিপর্যস্ত অবস্থা। নগরীর পূর্ব-অংশ মেজরটিলার অর্ধশতাধিক এলাকার অবস্থার চিত্র এক। মেজরটিলা থেকে বটেশ্বর এলাকা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। ডোবা, খাল ও পুকুরের পানিই ছিল ওই এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা। মেজরটিলা এলাকার আব্দুল কুদ্দুস জানালেন- বিদ্যুৎ না থাকার কারণে পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে। মানুষ পানির জন্য হাহাকার করছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। বিকল্প ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। কিংবা রেশনিং করে বিদ্যুৎ দেয়ার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা যেতো। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- শনিবার সন্ধ্যায় তারা সিলেট নগরীর বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ-১, ২ ও ৪ নং এলাকার বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছেন। এখনো ২০ ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। সিলেট নগরীর রিকাবীবাজার থেকে সুরমা মার্কেট এলাকা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। সিলেট নগরীর ১১, ১২ ও ১৩ নং ওয়ার্ড এখনো বিদ্যুৎ পায়নি। তিনটি ওয়ার্ডেই পানির জন্য হাহাকার চলছে। নগরীর শেখঘাট। ব্যস্ততম এলাকা। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস ওই এলাকায়। কাজীরবাজার মৎস্য আড়ত এখানে অবস্থিত। স্থানীয় কাউন্সিলর সিকন্দর আলী তার ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে পানি দিয়ে মানুষকে সহায়তা করছিলেন। কিন্তু তার এই সহায়তা পর্যাপ্ত ছিলো না। নগরীর ঘাষিটুলা, বেতেরবাজার, নবাব রোড এলাকায়ও তীব্র পানির সংকট দেখা দেয়। তালতলা, সুরমা মার্কেট এলাকা বাণিজ্যিক এলাকা। ওই এলাকায়ও গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা যায়নি। তালতলা এলাকার ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান জানিয়েছেন- বিদ্যুৎ না থাকার কারণে তিনদিন ধরে ব্যবসায়ীরা দোকান খুলতে পারছেন না। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে হোটেল-মোটেলও বন্ধ হয়ে পড়েছে। এছাড়া মাছুদিঘীরপাড়, তোপখানা এলাকার মানুষ বিদ্যুতের জন্য হাহাকার করছে। তিনি বলেন- বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে জরুরী ভিত্তিতে বিকল্প ব্যবস্থা করা উচিত। নতুবা মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা তার। স্থানীয় কাউন্সিলর সিকন্দর আলী জানান- বিদ্যুৎ না থাকায় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা খাবার পানি দেয়ার ব্যবস্থা করছি। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছেন। এদিকে- কিছুসংখ্যক মৌসুমি ব্যবসায়ী জেনারেটর নিয়ে মানুষের বাসাবাড়িতে যাচ্ছেন। তারা মোটরের সাহায্যে পানি তুলতে সাহায্য করছেন। এতে তারা নিচ্ছেন টাকাও। এতে করে মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নগরীর ভাতালিয়া, মেডিকেল এলাকায়ও পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সিলেটের বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বিতরণ বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন জানিয়েছেন- অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রপাতি   মেরামত ও পুনঃস্থাপন শেষে বুধবার সন্ধ্যা থেকে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ সবরাহ শুরু করেছি। এখনও আমাদের কর্মীরা গ্রিড লাইনে মেরামত কাজ করছেন। দুর্ঘটনার পর থেকে টানা কাজ করে যাচ্ছেন সবাই। আশা করছি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুরো সচল করা সম্ভব হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর জানিয়েছেন- সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ আসার পরপরই তারা সবক’টি জেনারেটর চালু করেছেন। চালু করেছেন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টও। রাত ৯ টার মধ্যে তারা সিলেট নগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সেসব এলাকায় গাড়িযোগে পানি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ আসা মাত্রই বাকি থাকা এলাকাগুলো পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা হবে বলে জানান তিনি।

বিকল্প নেই: সিলেটে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয় কুমারগাঁওয়ের ১৩২/৩৩ কেবি পাওয়ার প্লান্ট থেকে। এই প্লান্টটি হচ্ছে সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে সিলেট বিভাগের ৯০ ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। মঙ্গলবার ওই কেন্দ্রে আগুন লাগার কারণে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সিলেট। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সিলেটের ওই কেন্দ্রে সহসাই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার মতো ব্যবস্থাও ছিল না। এ কারণে গাজীপুর থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে বিকল্প ট্রান্সমিটার। ওই ট্রান্সমিটারের মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। অগ্নিকাণ্ডে প্লান্টের অর্ধেক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগের ২০০ কর্মী নিরলসভাবে কাজ করে বুধবার বিকালের মধ্যে নতুন ট্রান্সমিটার সংযোগ করেন। এর ফলে নগরীর অর্ধেকের বেশি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। কিন্তু ২০ ভাগ এলাকায় এখনো দেয়া হয়নি বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- সিলেটে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে হলে বিকল্প আরেকটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকার প্রয়োজন। কিন্তু সেই উপকেন্দ্র নেই। এ কারণে তাৎক্ষণিক বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status