এক্সক্লুসিভ
আমি শুধু জানতাম হলুদ রঙের বাসটি ধরে স্কুলে যেতে হয়
কাজল ঘোষ
১৫ নভেম্বর ২০২০, রবিবার, ৮:৩৫ পূর্বাহ্ন
বার্কলের বাস ছেড়ে আন্ট মেরি সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতায় যোগ দেন। সেখানে তিনি তার কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের নানা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন সকলের সঙ্গে। সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি ছিল শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পরিচালিত একটি পরীক্ষামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৬৬ সালে আমার মায়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হই, যাকে চিনতাম আঙ্কেল অব্রে বলে। তার হাত ধরেই ওই কলেজে কৃষ্ণাঙ্গ বিষয়ক পড়াশোনার শুরু। এই প্রতিষ্ঠানটি উচ্চশিক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই প্রসিদ্ধ।
তারা সকলেই ছিলেন আমার মায়ের আপনজন। যে দেশে আমার মায়ের কোনো পরিবার ছিল না সে দেশে তারাই ছিলেন আমার মায়ের পরিবার। আর তিনিও ছিলেন তাদের পরিবারের অংশ। ভারত থেকে এসে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন এবং তারাও তাকে সাদরে বরণ করে নেন। এটিই ছিল তার মার্কিন জীবনে বাসের মূল শক্তি।
আন্ট মেরি এবং আন্ট লেনর ছিলেন মা’র সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। আমার এখনও মনে আছে আমার মায়ের পরামর্শদাতা হাওয়ার্ডের কথা। মেধাবী এই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ছিলেন আমার মায়ের কাছের একজন পরামর্শদাতা। যিনি পরবর্তীতে আমার মা’কে আগলে রেখেছেন। আমি যখন বালিকা তখন তিনি জাপান থেকে আমার জন্য একটি মুক্তোর নেকলেস উপহার এনেছিলেন। মুক্তোর তৈরি গহনা ছিল আমার কাছে বরাবরই প্রিয়। আমি আমার মামা (বালু) এবং তার দুই মেয়ে সরলা এবং চিন্নির খুব কাছের একজন ছিলাম। চিন্নিকে আমি চিট্টি বলে ডাকতাম। চিট্টিকে আমি ছোট মা বলতাম। তারা থাকতো হাজার হাজার মাইল দূরে আর দেখা হতো কালে-ভদ্রে। যদিও আমরা অনেক অনেক দূরে থাকতাম তবু এই দূরত্বকে আমরা জয় করেছিলাম টেলিফোন, চিঠি, কার্ড এবং মাঝেমধ্যেই ভারত সফরের মাধ্যমে। এভাবেই আমাদের মধ্যে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। এভাবেই আমি প্রথম শিখতে পারলাম প্রতিদিন কারও সঙ্গে দেখা না হলেও তারা আপনজন হয়ে উঠতে পারে। যাইহোক না কেন আমরা সবসময় একে-অপরের জন্য ছিলাম।
আমার মা, দাদু, দিদি, খালা ও মামারা সকলেই গর্ববোধ করতে শিখিয়েছেন আমি দক্ষিণ এশীয় বলে। আমাদের নামগুলো সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবং আমরা ভারতীয় সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রভাবের মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মা যখনই দুঃখ প্রকাশ করতেন বা হতাশাবোধ করতেন তখনই তিনি তা করতেন মাতৃভাষায়। এবং আমার নিজের মধ্যেও একই বিষয় অনুভব করেছি। সেই আবেগের তাড়নায় আমার মায়ের সঙ্গে আমিও যুক্ত হতাম সবসসময়।
আমার মা খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে বড় করছেন। তিনি জানতেন নয়া মাতৃভূমিতে তার মেয়েরা কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই পরিচিত হবে। তিনি আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী এবং গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী ছিলেন।
বাবা-মা আলাদা হওয়ার এক বছরের মাথায় বার্কলের ব্যাঙ্কক্রাফট ওয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমরা থাকতে শুরু করি। সেখানে আমার প্রতিবেশীরা ছিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তারা একে-অন্যের জন্য জীবন ধারণ করতে এবং অর্থ ব্যয় করতে পছন্দ করতো। এটা ছিল এমন একটি সমাজ যেখানে তারা সন্তান মানুষ করতে ব্যয় করতে পছন্দ করতো। আমেরিকান ড্রিম বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানকার মানুষেরা ঠিক তাই বিশ্বাস করতো। তাদের ধারণা ছিল, তুমি যদি পরিশ্রমী হও, তাহলে তোমার সন্তান তোমার থেকেও ভালো হবে। আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে ধনী ছিলাম না। তবে ওই সমাজে থাকার কারণে যে মূল্যবোধের মধ্য থেকে আমরা বড় হতে পেরেছি তা ছিল আমাদের জন্য বড় সম্পদ।
আমার মা গবেষণাগারে যাওয়ার আগে প্রতিদিন সকালে আমাকে এবং ছোট বোন মায়াকে স্কুলের জন্য প্রসু্তত করে দিতেন। তিনি কাজে যাওয়ার সময় আমাদের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে যেতেন। তবে আমরা শুধু চকলেট, স্ট্রবেরি এবং ভ্যানিলার মধ্যে যেকোনো একটি ফ্লেবার বেছে নিতে পারতাম। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানাদিতে আমরা পপটার্স খেতে পারতাম। আমার মায়ের হিসেবে সকালের নাস্তা কোনো পেট পুরে খাওয়ার বিষয় ছিল না। তিনি আমাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানাতেন। এরপর আমরা বাড়ির কিনারা থেকেই স্কুল বাসে চড়তাম এবং থাউজেন্ড ওকস এলিমেন্টারি স্কুলে যেতাম। আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছি যে, আমরা ছিলাম বর্ণবাদ বিষয়ক পরীক্ষার অংশ। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা একদিকে পড়াশোনার সুযোগ পেতো এবং ধনী ও শ্বেতাঙ্গ শিশুরা অন্যদিকে পড়ার সুযোগ পেতো। তবে সেই সময় আমি শুধু জানতাম হলুদ রঙের বড় বাসটি ধরে স্কুুলে যেতে হয়।
কমালা হ্যারিসের অটোবায়োগ্রাফি ‘দ্য ট্রুথ উই হোল্ড’ বই থেকে
তারা সকলেই ছিলেন আমার মায়ের আপনজন। যে দেশে আমার মায়ের কোনো পরিবার ছিল না সে দেশে তারাই ছিলেন আমার মায়ের পরিবার। আর তিনিও ছিলেন তাদের পরিবারের অংশ। ভারত থেকে এসে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন এবং তারাও তাকে সাদরে বরণ করে নেন। এটিই ছিল তার মার্কিন জীবনে বাসের মূল শক্তি।
আন্ট মেরি এবং আন্ট লেনর ছিলেন মা’র সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। আমার এখনও মনে আছে আমার মায়ের পরামর্শদাতা হাওয়ার্ডের কথা। মেধাবী এই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ছিলেন আমার মায়ের কাছের একজন পরামর্শদাতা। যিনি পরবর্তীতে আমার মা’কে আগলে রেখেছেন। আমি যখন বালিকা তখন তিনি জাপান থেকে আমার জন্য একটি মুক্তোর নেকলেস উপহার এনেছিলেন। মুক্তোর তৈরি গহনা ছিল আমার কাছে বরাবরই প্রিয়। আমি আমার মামা (বালু) এবং তার দুই মেয়ে সরলা এবং চিন্নির খুব কাছের একজন ছিলাম। চিন্নিকে আমি চিট্টি বলে ডাকতাম। চিট্টিকে আমি ছোট মা বলতাম। তারা থাকতো হাজার হাজার মাইল দূরে আর দেখা হতো কালে-ভদ্রে। যদিও আমরা অনেক অনেক দূরে থাকতাম তবু এই দূরত্বকে আমরা জয় করেছিলাম টেলিফোন, চিঠি, কার্ড এবং মাঝেমধ্যেই ভারত সফরের মাধ্যমে। এভাবেই আমাদের মধ্যে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। এভাবেই আমি প্রথম শিখতে পারলাম প্রতিদিন কারও সঙ্গে দেখা না হলেও তারা আপনজন হয়ে উঠতে পারে। যাইহোক না কেন আমরা সবসময় একে-অপরের জন্য ছিলাম।
আমার মা, দাদু, দিদি, খালা ও মামারা সকলেই গর্ববোধ করতে শিখিয়েছেন আমি দক্ষিণ এশীয় বলে। আমাদের নামগুলো সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবং আমরা ভারতীয় সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রভাবের মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মা যখনই দুঃখ প্রকাশ করতেন বা হতাশাবোধ করতেন তখনই তিনি তা করতেন মাতৃভাষায়। এবং আমার নিজের মধ্যেও একই বিষয় অনুভব করেছি। সেই আবেগের তাড়নায় আমার মায়ের সঙ্গে আমিও যুক্ত হতাম সবসসময়।
আমার মা খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে বড় করছেন। তিনি জানতেন নয়া মাতৃভূমিতে তার মেয়েরা কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই পরিচিত হবে। তিনি আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী এবং গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী ছিলেন।
বাবা-মা আলাদা হওয়ার এক বছরের মাথায় বার্কলের ব্যাঙ্কক্রাফট ওয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমরা থাকতে শুরু করি। সেখানে আমার প্রতিবেশীরা ছিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তারা একে-অন্যের জন্য জীবন ধারণ করতে এবং অর্থ ব্যয় করতে পছন্দ করতো। এটা ছিল এমন একটি সমাজ যেখানে তারা সন্তান মানুষ করতে ব্যয় করতে পছন্দ করতো। আমেরিকান ড্রিম বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানকার মানুষেরা ঠিক তাই বিশ্বাস করতো। তাদের ধারণা ছিল, তুমি যদি পরিশ্রমী হও, তাহলে তোমার সন্তান তোমার থেকেও ভালো হবে। আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে ধনী ছিলাম না। তবে ওই সমাজে থাকার কারণে যে মূল্যবোধের মধ্য থেকে আমরা বড় হতে পেরেছি তা ছিল আমাদের জন্য বড় সম্পদ।
আমার মা গবেষণাগারে যাওয়ার আগে প্রতিদিন সকালে আমাকে এবং ছোট বোন মায়াকে স্কুলের জন্য প্রসু্তত করে দিতেন। তিনি কাজে যাওয়ার সময় আমাদের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে যেতেন। তবে আমরা শুধু চকলেট, স্ট্রবেরি এবং ভ্যানিলার মধ্যে যেকোনো একটি ফ্লেবার বেছে নিতে পারতাম। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানাদিতে আমরা পপটার্স খেতে পারতাম। আমার মায়ের হিসেবে সকালের নাস্তা কোনো পেট পুরে খাওয়ার বিষয় ছিল না। তিনি আমাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানাতেন। এরপর আমরা বাড়ির কিনারা থেকেই স্কুল বাসে চড়তাম এবং থাউজেন্ড ওকস এলিমেন্টারি স্কুলে যেতাম। আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছি যে, আমরা ছিলাম বর্ণবাদ বিষয়ক পরীক্ষার অংশ। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা একদিকে পড়াশোনার সুযোগ পেতো এবং ধনী ও শ্বেতাঙ্গ শিশুরা অন্যদিকে পড়ার সুযোগ পেতো। তবে সেই সময় আমি শুধু জানতাম হলুদ রঙের বড় বাসটি ধরে স্কুুলে যেতে হয়।
কমালা হ্যারিসের অটোবায়োগ্রাফি ‘দ্য ট্রুথ উই হোল্ড’ বই থেকে