মত-মতান্তর

এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যু: আমরা কেউ-ই ফেরেস্তা নই!

ডা. আলী জাহান, যুক্তরাজ্য থেকে

১৪ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন

রিপোর্টগুলো আবার পড়লাম। খুঁটে খুঁটে লাইন ধরে পড়লাম। কয়েকটি পত্রিকার রিপোর্ট একসঙ্গে মেলালাম। পুরো ঘটনা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে আমার কিছু ডাক্তার বন্ধুর (সাইকিয়াট্রিস্ট) সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। এখন যে দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসছে সেখানে কাউকেই ফেরেস্তা ভাবতে পারছি না। কমবেশি সকলেই আমরা পুলিশের এই হতভাগ্য কর্মকর্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী।

১. বলা হচ্ছে যে, ঘটনার আগে চারদিন ধরে আনিসুল করিম কথা বলছিলেন না। উনার কিছু মানসিক সমস্যা ছিল। কোন ধরনের সমস্যা তার কোনো বর্ণনা নেই। সাথে ব্লাড প্রেসার এবং হার্টের সমস্যা ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য করিমকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হয় (সোমবার)। ওইদিন দুপুর ১১টার সময় ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য’ তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বলা হচ্ছে, মাইন্ড এইড হাসপাতাল (ক্লিনিক)  মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়ার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। তাদের লাইসেন্স হচ্ছে ড্রাগ এডিক্টেডদের চিকিৎসা দেয়া। বাংলাদেশের এক অধ্যাপকের কথা অনুসারে, এটি একটি রহস্যময় ক্লিনিক। রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভেতর একজন ডাক্তার আছেন দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে মাইন্ড ক্লিনিকে নিয়ে আসার জন্য কারা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে? এই আত্মীয় ডাক্তার কি কোন খবর নিয়েছেন? উনি কেন ইনস্টিটিউটের মতো বড়ো হাসপাতাল ছেড়ে এই ছোট ক্লিনিকে গেলেন তার উত্তর আমার জানা নেই। হাসপাতালের ভেতর  কিছু রহস্যময় লোক চলাফেরা করে যাদের কাজ হচ্ছে রোগীকে ভাগিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। সেই আত্মীয় ডাক্তার কি তাদের হাতে পড়েছিলেন? তদন্ত হওয়া দরকার। জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের ভেতরে এবং বাইরে কারা এসব কাজে জড়িত তাদের নাম  প্রকাশ্যে আসা উচিত। কোন সাহসী ব্যক্তি এ কাজ করতে পারবেন? রথী মহারথীদের সামনে নিয়ে আসতে পারবেন? পরিচয়টা জানা প্রয়োজন।

২.  বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল/ ক্লিনিকগুলো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। হিসেবটা খুব সহজ। টাকা রোজগারের জন্য এই হাসপাতালগুলোর জন্ম হয়েছে। এখানে দোষের কিছু নেই। ব্যবসা বলে কথা। কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এমন কিছু করতে চাইবেন না যাতে তাদের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। এমন কিছু করতে চাইবেন না, যে কারণে তাদের রোগী আসা বন্ধ হয়। আইন-আদালতে গড়াতে পারে এমন কাজ নিশ্চয়ই তারা করতে চাইবেন না। মাইন্ড হাসপাতাল এ থেকে ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। ইচ্ছে করে কাউকে প্রহার করা বা হত্যা করা (কিছু  পত্রিকা, আত্মীয়-স্বজন এবং পুলিশ প্রশাসনের কারো কারো বক্তব্য) হাসপাতালের উদ্দেশ্য হতে পারে না। আমরা যারা বলছি, পুলিশের এএসপিকে ওখানে হত্যা করা হয়েছে তারা ভুল বকছি। সর্বোচ্চ বলতে পারেন ওখানে ক্লিনিক্যাল নেগলিজেন্স ( clinical negligence) আছে। কর্তাব্যক্তিরা ক্লিনিক্যাল নেগলিজেন্স আর মার্ডারের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন তো? ভিডিও দেখে এবং ঘটনার বর্ণনা শুনে তো মনে হয় না ইচ্ছেকৃতভাবে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যেভাবে রোগীর চ্যালেঞ্জিং বিহেভিয়ার সামাল দেয়া হয়েছে তা ভুল ছিল। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্যে রোগীকে ক্লিনিকের একটি নির্দিষ্ট রুমে নেয়া হয়েছে এমনটা ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে (বেসরকারি) এ ধরনের রোগীকে যেভাবে চিকিৎসা দেয়া হয় তার একটু উনিশ-বিশ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রোগীর হার্টের সমস্যা ছিল। এ ধরনের রোগীকে এভাবে চিকিৎসা দেয়ার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে তা বাংলাদেশে চলে আসছে। বলা যেতে পারে He was the wrong person in a wrong place in wrong time.

৩. উন্নত বিশ্বে (ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা অস্ট্রেলিয়া)  এ ধরনের  Acutely unwell (mostly psychotic) রোগীদের চিকিৎসা দেবার জন্য rapid tranquilisation policy রয়েছে, যা আমাদের কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোন ওষুধ কখন এবং কীভাবে ব্যবহার করা যাবে। আমি ধরে নিচ্ছি, মাইন্ড ক্লিনিক এই পলিসি অনুসরণ করেনি। যদি তারা তা অনুসরণ না করে থাকে তাহলে যেসব চিকিৎসক ওখানে চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। কোন ভিত্তিতে তারা তাদের নিজস্ব স্টাইলে এ ধরনের রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন তার একটি স্পষ্ট উত্তর আসা দরকার। Aggressive বা Violent রোগীদের নিরাপদভাবে কীভাবে সামলাতে হবে তা MAPA (Management of Actual and Potential Aggression) ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়। আমরা যারা যুক্তরাজ্যে মানসিক চিকিৎসা প্রদানের সঙ্গে জড়িত আছি তারা তো বটেই, বরং সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালের পরিচালক, নার্স, সাইকোলজিস্ট, রিসেপশনিস্ট, ওয়ার্ড বয় (নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট), ক্লিনার, ডাইনিং রুমের বাবুর্চিকেও প্রতিবছর দুই দিনের এই ট্রেনিং কোর্স পাস করতে হয়। ওই কোর্স শেখানো হয় কীভাবে রোগীর কোনো ক্ষতি না করে এবং স্টাফদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে Behavioural disturbances ম্যানেজ করা যায়। কখন ডাক্তারকে ডাকতে হয়। ডাক্তার না আসা পর্যন্ত কীভাবে রোগীকে সামাল দিতে হয়। রোগীর গায়ে হাত তোলা তো কল্পনাও করা যাবে না। মাইন্ড ক্লিনিক নিশ্চয়ই MAPA’র কথা শুনেনি। কেন শুনেনি? সবটাই কি ম্যানেজমেন্টের দোষ? চিকিৎসকদের কোন ভূমিকা নেই? উনারা নিশ্চয়ই বইয়ে এ ধরনের কথাবার্তা পড়েছেন। বাস্তবে প্রয়োগ করেননি কেন?

৪. এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যুতে একটি মামলা হয়েছে। মাননীয় আদালত ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। কীভাবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে এবং কতো তাড়াতাড়ি উনার অবস্থার অবনতি হয়েছে তা তাদের জানা আছে। ভিডিও’র দিকে খেয়াল করলেই বাংলাদেশের আদালত নিশ্চয়ই দেখতে পারবেন কে কে রোগীকে প্রহার করেছেন এবং কে কে রোগীকে ধরে রেখেছেন। হামলার বর্ণনা শুনে এবং ভিডিওতে দেখে আমাদের আদালত হাসপাতালের পরিচালক থেকে শুরু করে ওয়ার্ড বয় পর্যন্ত ১১ জনকে ৭ দিন করে রিমান্ড দিয়েছেন। ৭ দিন রিমান্ড! কেন রিমান্ড দেয়া হয়েছে? উত্তাপ কমানোর জন্য? কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপ দেখলেই তো স্পষ্ট হয়ে যায় ওখানে কী হয়েছে। বাংলাদেশে রিমান্ড মানে তো মধ্যযুগীয় প্রহার আর পর্দার অন্তরালের ফিসফিসানি। কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপ পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করার জন্য পুলিশকে সাতদিন সময় দিয়েছেন কোন যুক্তিতে? বরং ২৪ ঘণ্টার ভেতরে পুলিশ কেন ভিডিও দেখে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি সে জন্য পুলিশকে কেন কারণ দর্শানো হয়নি?

৫. আমি ভাবছি এ ঘটনার শিকার হয়ে আনিসুল করিম মারা না গিয়ে যদি ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ স্কুলের শিক্ষক আবদুল করিম মারা যেতেন তাহলে মহাপ্রতাপশালী পুলিশ কি  কিছু করতেন?  মাননীয় আদালত কি আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ড দিতেন? আমরা সবাই উত্তরটা জানি। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ করি না।

৬. আমাদের সকলের কম-বেশি চরিত্রের স্খলন হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ও সমাজ সেই স্খলনকে এখন আর দোষের কিছু মনে করে না। সুবিচার চাইলে আপনি কে তা প্রমাণ করতেই হবে। আপনি বাংলাদেশের একজন শান্তিপ্রিয় নাগরিক- এই পরিচয় আপনার সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। আপনাকে বেঁচে থাকতে হলে অথবা মারা যাবার পর বিচার পেতে হলে এই পরিচয়ের বাইরে অন্য পরিচয় দিতে হবে। অন্য অবলম্বন থাকতেই হবে। চাহিবামাত্র সেই পরিচয় দিতে হবে। সব সময় সেই পরিচয় আপনার জন্য সৌভাগ্য বয়ে না আনতে পারলেও মাঝে-মধ্যে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার সেই পরিচয় আছে তো?

লেখক: কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য।
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status