এক্সক্লুসিভ

ইন্টার্ন হিসেবে আমার স্মরণীয় যে ঘটনা

কাজল ঘোষ

১২ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:২৪ পূর্বাহ্ন

ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড। এখানকার অ্যালামেডা কাউন্টি সুপেরিয়র কোর্টহাউজে আমি তখন একজন কর্মী। প্রথমদিন সেখানে উপস্থিতি, হেঁটে বেড়ানোর কথা এখনো আমার স্মরণ আছে। সময়টা ছিল ১৯৮৮ সাল। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসে আমি ও অন্য নয়জনকে গ্রীষ্মকালীন ইন্টার্নশিপ প্রস্তাব করা হয়েছিল আগের গ্রীষ্মে, সর্বশেষ আইন নিয়ে পড়াশোনার সময়। আমার মধ্যে একটি প্রবণতা ছিল, আমি একজন প্রসিকিউটর হতে চাই। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে সামনের সারিতে আমি থাকতে চাই। বিপন্ন মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছি আমি। কিন্তু এমন কাজ আমার দৃষ্টিগোচরে ধরা দেয়া থেকে অনেক দূরে। তবু আমি মন থেকে আশা মুছে দিইনি। সেদিন কোর্টহাউজে সূর্যের উজ্জ্ব্বল আলো। লেক মেরিট-এ একাকী দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি- লম্বা। আশেপাশের অন্য ভবনের থেকে তাকে অধিক রাজকীয় দেখাচ্ছে। নির্দিষ্ট একটি কোণে, বিদেশের কোনো রাজধানী থেকে আনা মার্বেল দিয়ে তৈরি এক শিল্পকর্মের মতো দেখাচ্ছে। এর মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রানাইট। কংক্রিটের টাওয়ার আকাশ ছুঁয়েছে যেন কোনো সোনালী ছাদকে স্পর্শ করবে। অন্য এক কোণ থেকে দেখলে এটাকে মনে হয় কোনো বিয়ের দিনের কেকের মতো।

অ্যালমেডা কাউন্টি ডিস্টিক্ট এটর্নির অফিস নিজে থেকেই যেন এক কিংবদন্তি। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার আগে এই অফিসকে চালিয়েছেন আর্ল ওয়ারেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রধান বিচারপতিদের অন্যতম ছিলেন। চোখ ধাঁধানো মোজাইক লবির ভিতর দিয়ে যখন আমি সামনে হেঁটে যেতে থাকলাম, তখন ওইদিন সকালে তার কথা আমার মনে হলো, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম দিককার ইতিহাস ফুটে ওঠে এতে। ওয়ারেনের সেই কথাগুলো- যা উচ্চারিত হয়েছিল ‘সহজাত অসমতা’, তা ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলির জন্য প্রযোজ্য হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ১৫ বছর। এসব আমার জন্য সময়মতো এসেছে এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। প্রথম ওরিয়েন্টেশন সেশনে আমি সবার আগে আসলাম। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার সহকর্মীরা প্রবেশ করলেন। তার মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন নারী। তিনি হলেন অ্যামি রেজনার। এই অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমি তার কাছে গেলাম এবং তার ফোন নম্বর চাইলাম। পুরুষ অধ্যুষিত এই পরিবেশে, সেখানে ন্যূনতম একজন নারী সহকর্মী রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনিই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম। তার সন্তানদের কাছে আমি এখনো ধর্মমাতা।

গ্রীষ্মকালীন ইন্টার্ন বলে, বোধগম্য কারণেই আমাদের কোনো ক্ষমতা বা প্রভাব ছিল না বললেই চলে। আমাদের প্রাথমিক কাজ ছিল শেখা এবং পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি আমরা যেখানে, যেসব বিষয়ে সহায়তা করতে পারি তারও অনুমতি দেয়া হলো। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা ভিতর থেকে কীভাবে কাজ করে, রায় যখন দেয়া হয় তা কেমন হয় এবং যখন ন্যায়বিচার দেয়া হয় না-  তখন তা দেখা ও তা থেকে স্বাদ আস্বাদনের জন্য এটা ছিল আমার কাছে একটি বড় সুযোগ। ‘ড্রাইভিং আন্ডার দ্য ইনফ্লুয়েন্স’ বা ডিইউআই থেকে মানুষ হত্যার মতো মামলাগুলো নিয়ে অ্যাটর্নিরা যখন কাজ করেন, তখন তাদের সঙ্গে ছিলাম আমরা। একই সঙ্গে ওই রুমে থাকার সুযোগ ছিল আমাদের। অর্থাৎ বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ ছিলাম আমরা। সব মিলিয়ে একটি মামলায় আমরা সবাই যুক্ত থাকতাম।

মাদকের একটি মামলা নিয়ে আমার ঊর্ধ্বতনরা যখন কাজ করছিলেন, তখনকার সেই সময়টার কথা আমি কখনোই ভুলবো না। তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বেশকিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করলো। এর মধ্যে একজন নিরপরাধ পথচারীও ছিল। তিনি ছিলেন একজন নারী। তিনি ভুল সময়ে ভুল স্থানে ছিলেন। তাকেও জড়িয়ে ফেলা হলো। আমি ওই নারীকে দেখিনি। জানিও না যে, তিনি কে বা তিনি দেখতে কার মতো। এ বিষয়ে যে রিপোর্ট হয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা ছাড়া তার সঙ্গে আমার কোনো যোগসূত্রও নেই। কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু আমি পেলাম যা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো।

এটা ছিল শুক্রবারের পড়ন্ত বিকাল। বেশির ভাগ মানুষই কাজ শেষে সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর জন্য বাড়ি চলে গেছেন। স্বভাবতই সোমবার না আসা পর্যন্ত তার মামলাটি কোনো বিচারকের টেবিলে উঠবে না। এর অর্থ হলো- ওই নারীকে সাপ্তাহিক ছুটির সময়টা জেলেই কাটাতে হবে। তিনি কি ছুটির দিনে কাজ করেন? তিনি কোথায় আছেন, এ বিষয়ে কি তিনি তার চাকরিদাতাকে কোনো ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছেন? তাকে কি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে?

আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জানতে পারলাম বাসায় তার ছোট ছোট বাচ্চা আছে। তারা কি জানে যে, তিনি জেলে আছেন? হয়তো তারা ভেবেছে, তিনি কোনো অন্যায় করেছেন। এখন এই বাচ্চাদের কে দেখাশোনা করছে? তাদের যত্ন নেয়ার জন্য কি কেউ আছেন? এ অবস্থায় চাইল্ড প্রটেকটিভ সার্ভিসেসকে ডাকা যেতে পারে। হায় খোদা, তিনি তার বাচ্চাদের হারাতেও পারেন।

সবকিছু ছিল এই নারীর পক্ষে। তার পরিবার, তার জীবিকা, তার সম্প্রদায়ের পক্ষে তার অবস্থান, তার সততা, তার স্বাধীনতা- সবই ছিল তার পক্ষে। তাই তিনি কোনো অন্যায় করেননি।

আমি দ্রুত আদালতের ক্লার্কের কাছে ছুটে গেলাম এবং এই মামলাটি ওইদিনই আদালতে তোলার অনুরোধ করলাম। আমি অনুনয়, বিনয় করলাম। আমি বিনীত আবেদন করলাম, বিচারক যদি শুধুমাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য বেঞ্চে বসেন, তাহলে আমরা এই নারীকে মুক্ত করতে পারি। আমি সবচেয়ে যা নিয়ে খুব ভেবেছি তা হলো, তার পরিবার এবং ভীতসন্ত্রস্ত তার সন্তানদের কথা। শেষ পর্যন্ত দিনের শেষ সময়টা যখন ক্রমাগত বিদায় নেয়ার পথে তখন বিচারক ফিরে এলেন। তিনি ওই নারীর মামলাটি যখন রিভিউ করছেন, শুনছেন- তখন আমি তা পর্যবেক্ষণ করলাম। অপেক্ষা করলাম তার রায়ের জন্য। অবশেষে হাতুড়ি দিয়ে টেবিলে গর্বের সঙ্গে আঘাত করা হলো এবং এর মতোই তিনি মুক্ত হলেন। ফলে ওই নারী রাতের খাবার তার সন্তানদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে যেতে পারলেন। তার সঙ্গে আর কখনো সাক্ষাতের সুযোগ পাইনি আমি। কিন্তু তাকে কখনোই ভুলে যাইনি।

এটা ছিল আমার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় কতটা ব্যতিক্রমী এবং কতটা মানবিক ব্যাপার ঘটতে পারে তা যেন এক স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে দিয়েছে এই ঘটনা। এটা একটা অনুধাবনের বিষয় যে, একজন ইন্টার্নের সীমিত কর্তৃত্বের অধীনে থাকলেও কীভাবে ন্যায়বিচার দেয়া যায়। এটা এক উদ্দীপনামূলক মুহূর্ত, যা প্রমাণ করে কীভাবে মানুষের জন্য একজন প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সহানুভূতি বড় ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। একটি বড় প্রসিকিউটর অফিস চালানোর জন্য আমি নির্বাচিত হওয়ার অনেক বছর আগে, এটাই ছিল আমার জয়ের অন্যতম, যা সবচেয়ে বড় কিছু মনে হয়। আমি জানি ওই নারী বাড়ি চলে গেছেন। আমি এও জানি যে, আমি কি ধরনের কাজ করতে চাই এবং আমি কাদেরকে সেবা করতে চাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status