মত-মতান্তর

ট্রাম্পের গণতন্ত্র!

ড. মাহফুজ পারভেজ

৯ নভেম্বর ২০২০, সোমবার, ৫:৪৬ পূর্বাহ্ন

নানা রকমের গণতন্ত্রের কথা শোনা যায়, যার মধ্যে স্বৈরাচারের ছায়াও থাকে। হিটলারও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী হয়েছিলেন। ট্রাম্প ২০১৬ সালে যেভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ২০২০ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ক্ষমতা না ছাড়ার তাল করছেন, তাতে গণতন্ত্রের চেহারায় কালো কালি পড়েছে। একই সঙ্গে 'ট্রাম্পের গণতন্ত্র' নামে ক্ষমতা না ছাড়ার একটি নিকৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে।

বিষয়টি মার্কিন দেশে অকল্পনীয়, যদিও উন্নয়নশীল দেশে এমনটি প্রায়ই হতে দেখা যায়। ক্ষমতার থেকে শাসকদের চরিত্রের এমনই পরিবর্তন ঘটে যে, অনেকেই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী মনে করেন। পারতপক্ষে ক্ষমতা ছাড়তে চান না এবং ক্ষমতার পালাবদল অনেক সময়েই শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতহীন হয় না।

ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এহেন কুলক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমেরিকার মতো সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দেশে ক্ষমতা না ছাড়ার এমন নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক সংস্কৃতি তিনি কে বা কার কাছ থেকে শিখলেন, তা এক আশ্চর্যজনক বিষয়ই বটে। নির্বাচনের আগেই তিনি এই বলে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন যে, পরাজিত হলে তিনি হোয়াইট হাউস ছাড়বেন না।

যদিও মার্কিন বিধানে তার ক্ষমতা ছাড়া না ছাড়া বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ, নিয়মানুযায়ীই তিনি ক্ষমতাহীন ও সাবেক হয়ে যাবেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো জোর করে ক্ষমতায় থাকার কোনো সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদৌ নেই।

কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। উগ্র ও দক্ষিণপন্থী এই নেতা যেভাবে 'আমরা এবং ওরা' বলে সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীকে বিভাজিত করেছেন, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদকে উস্কে দিয়েছেন এবং সংখ্যালঘু ও অভিবাসীদের দলন-পীড়নের হুমকি দিয়েছেন, তাতে তার পক্ষে হটকারিতামূলক কোনো কিছু করে ফেলা অসম্ভব নয় মোটেই।

বলা বাহুল্য, ট্রাম্প এখনো পরাজয় মানেননি। মানবেন না বলেই মনে হচ্ছে। উল্টো কারচুপির অভিযোগ এনে আদালতে নালিশ করেছেন। মার্কিন গণতন্ত্রের ট্র্যাডিশনও ভেঙেছেন তিনি। বিজয়ী বাইডেনকে ফোন করে এখনো অভিনন্দন জানাননি। সারা বিশ্বের উল্টো পথে চলার কথা বলছেন তিনি।

নিজেই নানা ভাষণ ও বক্তৃতায় নিজের গুয়ার্তুমি ও অভিরুচি কথা বার বার অকপটে বলেছেন। সারাজীবন যে করেই হোক জিতে আসা এই লোকটি পরাজয় শব্দটিকে ঘৃণা করেন। আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন তিনি তাকে হারানো বাইডেনের পাশে পরাজিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন কিনা সেই প্রশ্ন এখন উঠেছে। এই অপমান থেকে বাঁচার জন্য তিনি মাইক পেন্সের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করতে পারেন। বা করতে পারেন এমন কিছু, যা অভাবণীয়।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন যে, বেশ কয়েক কারণে ট্রাম্প বাইডেনের অভিষেকের আগে পেন্সকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিতে পারেন। ট্রাম্প নিজের, তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের যাবতীয় অনিয়ম, কুকীর্তি ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নিশ্চয় একটি পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন। ট্রাম্প হয়ত পেন্সকে দিয়ে একটি ইনডেমনিটি ধরনের আইন করে ট্রাম্প ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিচার চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারেন।

এ কথা সবার জানা যে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগের তদন্ত চলছে। নতুন সরকার যে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধূর্ত ট্রাম্প তাই আগেভাগেই হয়তো এ ধরনের কিছু একটা করার চিন্তা করছেন। তিনি নিজের পিঠ বাঁচাতে কিছু না কিছু অবশ্যই করবেন। একতরফা হেরে যাওয়ার মানুষ হবেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শাসনকালে যে প্রক্রিয়া চালু করে নিন্দিত ও আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন, তেমনিভাবে গণতন্ত্রের বিকৃতি ঘটালে, তা হবে মার্কিন দেশের জন্য চরম বেদনার ও তীব্র বিপদের কারণ। 'ট্রাম্পের গণতন্ত্র' নামে কোনো হটকারিমূলক কুপ্রথার উদ্ভব যদি তিনি ঘটান তবে, তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় ও নিকৃষ্ট রীতি রূপে বিবেচিত হবে এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারীদের মদদ দেবে।

ভয়টা এজন্যই যে মার্কিন নির্বাচন শেষ হলেও রাজনীতির অনেক কিছুই এখনো বাকী এবং ট্রাম্প সাহেবও পরাজয় মেনে একেবারে চুপ করে বসে নেই। ফলে ২০২০ সালের বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে অনুষ্ঠিত চরম উত্তেজক ও নাটকীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ যবনিকা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status