মত-মতান্তর

আমেরিকানদেরও গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে!

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

৭ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ১০:১৩ পূর্বাহ্ন

বিশ্বের সব দেশ, সব মানুষের দৃষ্টি এখন আমেরিকার দিকে। আরও একটু সুনির্দিষ্টভাবে বললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটযুদ্ধের দিকে। কে জিতবেন নির্বাচনে? আরও চার বছর হোয়াইট হাউজ ট্রাম্প মশায়ের দখলে থাকবে? নাকি জো বাইডেন বুঝে নেবেন এর দখল? এ মুহুর্তে সারা দুনিয়ার সমস্যা যেন এই একটাই! আর কোন সমস্যা নাই। এক প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে মধ্য আমেরিকা,  মৃত্যু হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষের। এত বড় একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশেই। এসব কারও চোখে পড়ছে না। ট্রাম্প না জো বাইডেন- কে বসছেন আমেরিকার মসনদে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কেন? শুধুই কৌতুহল? বুঝতেই পারছেন, কৌতুহল তো আছেই। তবে, এটা স্রেফ কৌতুহল নয়। পৃথিবী নামের এই গ্রহের সবচেয়ে শক্তিধর এ দেশটির ক্ষমতায় কে আসছেন, তার সাথে শুধু আমেরিকানদের ভাগ্যই নয়, সারা দুনিয়ার অনেক বিষয়-আশয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এ নিবন্ধ লেখার সময়কাল পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি, কে বুঝে পাচ্ছেন হোয়াইট হাউসের টিকেট। ঝুলে আছে ক’টি সুইং স্টেটের ফলাফলের ওপর, যেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দু’একদিনের মধ্যেই হয়তো মোটামুটি একটি পরিস্কার ছবি পাওয়া যাবে। তবে, যতই সময় গড়াচ্ছে, ভোট গণনা এগিয়ে যাচ্ছে, জো বাইডেনের জয়ের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এতেই ক্ষেপে যাচ্ছেন ট্রাম্প মশায়। ভোট গণনায় কারচুপির অভিযোগ তুলছেন, দাবি তুলছেন পোস্টাল ব্যালট গণনা বন্ধের, এমনকি ক’টি রাজ্যে মামলাও ঠুকে দিয়েছেন। উভয়পক্ষের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও সহিংসতায়ও জড়িয়ে পড়ছে।

আমেরিকার জন্য এ এক কঠিন পরীক্ষা। পৃথিবীর যে সব দেশে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল, সেখানে নির্বাচন শেষে এমন পাল্টাপাল্টি দাবি হলে কেউ অবাক হতো না। ওখানে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যেতে কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাজনীতিবিদরা যে কোন কলা-কৌশল অবলম্বনে লাজ-লজ্জার ধার ধারেন না। কিন্তু, এ তো আমেরিকা! জর্জ ওয়াশিংটন-আব্রাহাম লিংকনদের আমেরিকা! জ্ঞান-গরিমা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সভ্যতা-ভব্যতায় সারা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আমেরিকা! এটা কি সেই আমেরিকাই নয়, যে কিনা প্রতিনিয়ত সারা দুনিয়াকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক দিতে অভ্যস্ত? সেই আমেরিকাতে ট্রাম্পের মতো একজন বর্ণবাদী আধা-পাগল টাইপের লোক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, আর দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হতে পারছেন না দেখে আবোল-তাবোল বকবেন, কারচুপির অভিযোগ তুলবেন, এটাই কি প্রত্যাশিত ছিল? তাহলে এটা কি প্রমাণ করে, আমেরিকান সমাজে সভ্যতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে বর্ণবাদ ও অসভ্যতার এক দগদগে ঘা?

তবে, অনেক বিশ্লেষকই এতে খুব বেশি অবাক হচ্ছেন না। আমেরিকানদের একটি বড় অংশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদ আর জাত্যাভিমানকে উস্কে দিয়েই ত ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন। আব্রাহাম লিংকন যাদের পরাভূত করে আমেরিকাকে দাসপ্রথার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিলেন, সেই বৈষম্যবাদীরা এখনও যে আমেরিকায় যথেষ্ট সক্রিয়, ট্রাম্পের মতো লোকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠান কি তারই প্রমাণ বহন করে না? এ তো গেল ঘটনার একটি দিক। আরেকটি দিকে আমরা প্রায়ই নজর দিতে ভুলে যাই। সন্দেহ নাই, আমেরিকাতে অনেক সত্যপ্রিয়, সংবেদনশীল, সুন্দর মননের মানুষ আছেন। কিন্তু, জাতিগতভাবে তারা কি দুনিয়ার তাবৎ মনুষ্যকুলকে তাদের সাথে একই কাতারে বিচার করেন? আপনি দেখে থাকবেন, দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে কোন আমেরিকানের গায়ে একটা ফুলের টোকাও যদি লাগে, পুরো আমেরিকা ফুঁসে উঠে। কিন্তু, জাপান, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে আমেরিকান বোমায় যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আমেরিকানদের হৃদয় এতটুকু কম্পিত হয় না।

মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-গরিমায় উন্নতির ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্রের আবির্ভাব এ বিশ্বের জন্য বিরাট আশীর্বাদ স্বরূপ। এটি একদিকে যেমন ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাত-বদল নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে এনে দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করার এক অপূর্ব সুযোগ। আমেরিকা-ব্রিটেনসহ বিশ্বের যে সব দেশে গনতন্ত্র শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে হঠাৎ স্বৈরতন্ত্র তার জায়গা দখল করে বসবে তেমনটি হয়ত পাগলেও ভাববে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বময় তাদের মোড়লিপনার সুবাদে তাদের প্রভাব বলয়ে আছে এ রকম দেশসমূহেও কমবেশি গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। এমনকি, যেসব দেশে প্রকৃত অর্থে গনতন্ত্র নেই, স্বৈরতন্ত্র চলছে- এমন অনেক দেশও বছর পাঁচেক পর পর লোক দেখানো ভোটের নাটক মঞ্চায়নে বাধ্য হচ্ছে।

তবে, আপনি একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন, যে সব দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র চলছে সেসব দেশে যে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হচ্ছে না, তার জন্য এসব মোড়লরাই বহুলাংশে দায়ী। মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশে যে শেখতন্ত্র টিকে আছে, গণতন্ত্র আসছে না, তা এসব মোড়লদের আশীর্বাদেই নয় কি? তারা নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চা করলেও আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থই কি মূখ্য ভূমিকা রাখে না? কাজেই, আপনি দেখে থাকবেন, তারা এসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চা কেবল ততক্ষণ স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, যতক্ষণ তারা দেখতে পান, নির্বাচনে তাদের পছন্দের লোক জিতে আসছেন। অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা এসব দেশে জাতীয়তাবাদী নেতাদের ক্ষমতায় আনতে পারে, যারা হয়তো তাদের শিখন্ডি হিসেবে কাজ করতে রাজি হবেন না। এখানেই তাদের যত আপত্তি। একারণে মিশরে হাজারো মানুষের রক্ত ঝরানো আল-সিসি কিংবা জ্যান্ত মানুষকে টুকরো টুকরো করে গুমের দায়ে অভিযুক্ত সৌদি যুবরাজ এমবিএস তাদের অতটা বিচলিত করে না, অন্য দিকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন জোগাতে তাদের বিবেকে বাধে না। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডই একটি বড় বাধা নয় কি? ট্রাম্প ও তার অনুসারীদের মতো একটি শক্তিশালী অংশ নিজ দেশেই যেখানে নাগরিকদের বর্ণ-গোত্রে বিভক্ত করার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ খুঁজে ফিরছেন, সেখানে মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব মোড়লেরা বিশ্বময় সাম্য, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসবেন সে আশা সুদূর পরাহত বৈকি!

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status