প্রথম পাতা

লালমনিরহাটে বর্বরতা

সেদিন কী ঘটেছিল

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

১ নভেম্বর ২০২০, রবিবার, ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

বিভীষিকাময় ঘটনা। একটি গুজব। নৃশংসভাবে কেড়ে নিলো একটি তাজা প্রাণ। পিটিয়ে হত্যা করা হলো একজন মানুষকে। হত্যার পর জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানো হলো তার লাশ। হিংস্রতা দেখে থমকে গেছে সারা দেশ। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি। কী ঘটেছিল সেই রাতে। কেন, কারা হত্যা করলো রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহিদুন্নবী জুয়েলকে। এ বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

রংপুর থেকে আবু ইউনুস শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার বন্ধু বৃহস্পতিবার বুড়িমারী স্থল বন্দরে বেড়াতে যান। ফেরার সময় আসরের নামাজ পড়তে বুড়িমারী বাজারের পাশে মসজিদে যান। ওই মসজিদের মুসল্লিরা জানান, নামাজ শেষে শহিদুন্নবী মুসল্লিদের বলেছিলেন ‘আমরা সরকারের একটি গোয়েন্দা শাখার লোক। রংপুর থেকে এসেছি। মসজিদ তল্লাশি করবো। এখানে অস্ত্র রয়েছে।’ এসময় শহিদুন্নবী ও তার সহযোগী মসজিদে থাকা র‌্যাক তল্লাশি করেন। র‌্যাক তল্লাশি করার সময় পবিত্র কোরআন শরীফ নিচে পড়ে যায়। এতে উচ্ছৃঙ্খল কিছু যুবক গুজব রটিয়ে দেয় যে, কোরআন শরীফে পা দিয়ে অবমাননা করেছেন শহিদুন্নবী।

দ্রুত এই গুজব ছড়িয়ে যায় মোবাইলফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। গুজব ছড়িয়ে পড়লে মসজিদে ছুটে যেতে থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ সময় কয়েক যুবক শহিদুন্নবী ও তার সঙ্গী ব্যক্তিকে মারধর করে। খবর পেয়ে ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দুইজনকে উদ্ধার করে পাশের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে নিয়ে যান। ততক্ষণে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হয় সেখানে। এ সময় উত্তেজিত লোকজন বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ভাঙচুর করে। এবং ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে ঢুকে শহিদুন্নবী ও তার সঙ্গীকে মারধর করে জড়ো হওয়া লোকজন। পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটে। পুলিশ কয়েক দফা বাধা দিতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা চালান বিক্ষুব্ধ যুবকরা। এরমধ্যে চেষ্টা চালিয়ে তাদের কাছ থেকে একজনকে উদ্ধার করে পুলিশ।  

ওই সময়ে পরিষদের সচিবের রুমে শহিদুন্নবীকে চারপাশ থেকে ঘিরে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিলো। তিনি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করলেও সেই শব্দ সেভাবে শোনা যাচ্ছিলো না। ওই শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিলো হামলাকারীদের দেয়া ধর্মীয় স্লোগান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুসারে এক পর্যায়ে পরিষদে থাকা সেলাই মেশিন দিয়ে থাকা শহিদুন্নবীকে আঘাত করে হত্যা করা হয়। রক্তে ভেসে যায় ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের ওই কক্ষ। পরে হামলাকারীরা তার লাশ দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায় প্রায় ৫শ’ গজ দূরে বুড়িমারী মহাসড়কে। বাঁশকল নামক স্থানে তার লাশটি ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে লাশ আগুনে পোড়ানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এতে সারা দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে যায়। নৃশংস গণপিটুনি দিয়ে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মারধরের সময় অনেকে বাধা দিলেও হামলাকারী যুবকদের সঙ্গে পেরে উঠেননি তারা। হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল অনেক।
বুড়িমারীর বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম জানান, পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার গুজবটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো মোবাইলফোনের মাধ্যমে। তারপর বিভিন্ন মসজিদ থেকে দলে দলে লোকজন ছুটে গেল। অনেকের মাথায় টুপিও নেই। তারা বেশির ভাগই ছিল যুবক। তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানান তিনি।

শহিদুন্নবীকে হত্যা ও লাশ আগুনে পোড়ানোর ঘটনায় হতভম্ব বুড়িমারীর সাধারণ মানুষ। একটি গুজবের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করছেন তারা। ওই এলাকার বাসিন্দা রফিকুল প্রধান বলেন, আমরা সেই রাত থেকে ঘুমাতে পারি না। চোখে বারবার ভাসছে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য। একই কথা বলেছেন বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহ নেওয়াজ নিশাদ। তিনি জানান, ঘটনার দিন হামলাকারী মানুষগুলো নরপশু হয়ে গিয়েছিল। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে ঢুকে তারা ভাঙচুর করে হত্যাকাণ্ড ঘটালো। তারা কারও বারণ শুনেনি। এরকম দৃশ্য কল্পনাও করতে পারেন না এই জনপ্রতিনিধি। চরম হিংস্রতায় একজন জীবন্ত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে তার লাশ পোড়ানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ওই এলাকায় টহল জোরদার করেছে।

নৃশংস এই ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে পাটগ্রাম থানায়। শনিবার সকালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল ওহেদ মিয়া ও রংপুর ডিআইজি দেব দাস ভট্টাচার্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। আর যেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা না ঘটে, এজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম নওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলায় ২২ জনের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।  অজ্ঞাত ৫শ’ থেকে ৬শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। তার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে হামিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে। ইউপি চেয়ারম্যান তার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হামিদুল ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি ওই ব্যক্তিকে মারধর করছিলেন। হামিদুলের বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। এ ছাড়া ওই সময় দায়িত্ব পালন করতে গেলে পুলিশ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। পাটগ্রাম থানার এসআই এম শাহজাহান আলী বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন।

নিহত আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহিদুন্নবী জুয়েল সম্পর্কে তার পরিচিতজনরা জানান, তিনি ছিলেন সজ্জন ও ধার্মিক। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভালো। কারও সঙ্গে কখনোই খারাপ আচরণের নজির নেই তার। ছাত্রজীবন থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। তবে শহিদুন্নবীর মানসিক সমস্যা ছিল বলে জানান তার পরিবারের সদস্যরা। তার বড় ভাই আবু আক্কাস মেহেদুন্নবী পলাশ জানান, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের লাইব্রেরিয়ানের পদ থেকে গত বছরের ১২ই সেপ্টেম্বর বাধ্যতামূলক অবসরে দেয়া হয় তাকে। এরপর থেকেই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। একটু এলোমেলো কথা বলতো। এ কারণে তাকে মানসিক চিকিৎসাও দেয়া হয়েছে। আবু আক্কাস মেহেদুন্নবী পলাশ বলেন, আমার ভাই এমন কোনো অপরাধ করেনি যে, তাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তার মতো একজন ভালো মানুষকে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে- তা কল্পনাও করতে পারছি না। তিনি এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

নিহত আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহিদুন্নবীর বাড়ি রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ায়। তার আট বছরের এক পুত্র সন্তান, এক কন্যা ও স্ত্রী রয়েছে। শহিদুন্নবীর রংপুরের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতের ভাই সাইফুল আলম বিপ্লব জানান, মানুষ হয়ে মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে- এটা ভাবতেও কষ্ট লাগে। তিনি বলেন, আমার ভাই অপরাধ করলে পুলিশে দিতো। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, এমন বিচার চাই যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।

এদিকে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে.এম.এ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status