শেষের পাতা

ওদের স্বপ্নগুলো পুড়ে ছাই

মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১ নভেম্বর ২০২০, রবিবার, ৯:১০ পূর্বাহ্ন

কল্যাণপুরের নতুনবাজার বস্তিতে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। নিম্নআয়ের মানুষের
মাথা গোঁজার ঠাঁই এখানে।
সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মযুদ্ধ শুরু করেন তারা। কেউ রিকশা চালান আবার কেউ শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ কেউ ভিক্ষা করেও চালান সংসার। প্রতিদিনের মতো ঘামঝরা পরিশ্রম করে নীড়ে ফিরেছিলেন মানুষগুলো। ক্লান্ত শরীর। সারাদিনের পরিশ্রম আর রাতের ঘুম। এই তো জীবন। সেই জীবনে নেমে আসলো অন্ধকার। পুড়ে ছাই হলো স্বপ্ন। আগুনের আলোতে ঝলসে গেল একেকজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই। গত শুক্রবার রাত পৌনে ৯টায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে। দুই ঘণ্টায় পুড়ে যায় ৭০টি ঘর। নিঃস্ব প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। কল্যাণপুরের নতুন বাজার বস্তিতে ১০টি সেকশন রয়েছে। ৭ নম্বর সেকশনে রয়েছে ৭০টির মতো ঘর। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গত শুক্রবার রাতে ৭ নম্বর সেকশনের ‘মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ইস্পাত ভাঙ্গাড়ির দোকানে গ্যাস সিলেন্ডারে বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তেই আগুন পাশের আসবাবপত্রের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে পুড়তে থাকে স্বপ্ন। নির্বিকার তাকিয়ে ছাড়া যেন কিছুই করার নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন এই দোকান থেকেই লেগেছে আগুন। সরজমিন দেখা যায়, বস্তিতে পোড়া ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে বেড়াচ্ছে সব হারানো মানুষ। সেখানেই খুঁজে ফিরছে কিছু অবশিষ্ট আছে কি না। বেশির ভাগ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেনি বাসিন্দারা। নিজের ঘরটির সামনে গিয়ে করছেন আহাজারি। সরজমিন গিয়ে কথা হয় এমন একজনের সঙ্গে। সাজিয়া বেগম। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। এক বছর ধরে টাকা জমিয়ে গত মাসে কিনেছিলেন একটি ফ্রিজ। তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার। স্বামী নেই। গত বৃহস্পতিবারে কিস্তিতে একটি সমিতি থেকে বিশ হাজার টাকাও তুলেছিলেন। সেই টাকা ঘরেই ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে তার। তিনি বলেন, এখন আমার মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি এখন কি করবো? গৃহহীন হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ মানুষ। তাদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠছিলো বস্তি এলাকা। অনেকের টাকা-পয়সা, পরনের কাপড়-চোপড়, ঘুমানোর খাট সবকিছুই পুড়ে গেছে। বস্তিবাসী আলেহা আক্তার বলেন, পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই। দুপুরে কাজ করতে বের হয়েছি। তিনটি বাসায় কাজ করে ফিরতে ফিরতে অনেক সময় লেগেছে। বাসায় ফিরে শুনি আগুন। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে নিঃস্ব আরেক ভুক্তভোগী রাসেল মিয়া। বস্তিতে একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। পাশের আরো চারটি ঘরে তার মা, ভাই-বোনদের বসবাস। ধার-দেনা করে একটি ফার্নিচারের দোকান গড়েছেন, যা তার আয়ের একমাত্র উৎস। ২৬ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার আর আয়ের পথ মাত্র দুই ঘণ্টায় পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। বস্তির সামনের অংশে একটি পুরনো ফার্নিচার বেচা-কেনার দোকান ছিল রাসেলের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাসেল বলেন, আমার ঘরের পাশের ভাঙ্গাড়ির দোকানে একটা প্রেসার মেশিন আছে। হঠাৎ ওইখানে একটা আওয়াজ হইলো। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধইরা গেল। তখন যদি ঘরের মাল বের করতে যাই, তাইলে আর ছেলেমেয়ে বাঁচাইতে পারি না। মালামালের দিকে আর তাকাইতে পারি নাই, পোলাপানগুলোরে কোনোভাবে বাইর করছি। তাও আমার বাচ্চার পা একটু পুড়ছে। তিনি বলেন, গতকাল একটি সমিতি থেকে ব্যবসার কাজের জন্য দুই লাখ টাকা লোন তুলেছিলাম। টাকা ছিল ঘরের আলমারিতে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেই টাকা। পুড়েছে ঘরে থাকা গহনা, দামি মালামাল। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল আমার। এখন আমি কীভাবে কি করবো, মাথায় ধরছে না।
মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ দোকানটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। স্থানীয়রা বলছেন, দোকানটি নান্নু মোড়লের। জানা গেছে, আগুন লাগার সময় দোকানে ছয়জন ছিলেন। দোকান মালিকের বন্ধু মাইনুল উদ্দিন জানান, তার বন্ধু নান্নু মোড়ল, স্ত্রী রুবি, কর্মচারী আমিরুল ও দোকানে ব্যবসায়িক কাজে আসা একজন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে কর্মচারী ও বহিরাগত ব্যক্তি বেশি আহত। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন বলেন, আমাদের ধারণা ভাঙ্গাড়ি দোকানের অরক্ষিত বিদ্যুৎ সংযোগ কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। সেখান থেকে আগুন পাশে কাঠের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মুহূর্তে তা পেছনের বস্তিতে ছড়িয়ে যায়।
তিন সদস্যের কমিটি গঠন: কল্যাণপুরের নতুন বাজার বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আগুনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে। রাত ১০টার পর কল্যাণপুরের ওই বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে। পরে মোট ১৫টি ইউনিট ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় রাত ১১টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কর্মীরা আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হন রাত ২টার পর।
অগ্নিদগ্ধ দুইজন: এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুইজন দগ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানিয়েছেন, আহত দুইজন হলেন, আনোয়ার (২১) ও আক্তার (১৯)। তাদের দুইজনের শরীরেরই প্রায় ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হবে পাঁচ হাজার টাকা করে: অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটি পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে জানিয়েছেন মো. আতিকুল ইসলাম। এ ছাড়া তার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সেখানে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ডিএনসিসির অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প ও মোবাইল টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের যাবতীয় দেখাশোনার জন্য ১১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল মান্নানকে সার্বক্ষণিক তদারকি করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status