মত-মতান্তর

পর্যবেক্ষণ

পুলিশের লজ্জাবোধ ও মানবিক চেতনা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

২৯ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদ(৩৪) কে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। কিন্তু হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
গত ২৭ অক্টোবর সিলেটে পৌঁছান নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন পুলিশ কমিশনার মোঃনিশারুল আরিফ। তিনি সিলেটে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (রহ) ও হযরত শাহ পরান (রহ) এর মাজার জিয়ারত করে প্রয়াত রায়হান আহমদের বাড়িতে যান। রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত তিনি রায়হানের পরিবারের সদস্যদের সাথে একান্তে কথা বলেন। এরপর বাড়ির উঠোনে প্রেস ব্রিফিং করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন রায়হান হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি 'অপ্রত্যাশিত' ও 'অনভিপ্রেত'। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা জড়িত থাকায় আমি 'লজ্জিত'। এর মধ্যে পুলিশি হেফাজত থেকে বরখাস্ত এসআই আকবরের পালিয়ে যাওয়া আরো 'লজ্জার'। কমিশনারের এ উপলব্ধি অবশ্যই 'বিরল' এবং 'প্রশংসনীয়' ।

একজন পুলিশ কমিশনার পুলিশ বিভাগের দায় ও দায়িত্ব স্বীকার করেছেন, নৈতিক কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়েছেন। এই ধরনের কর্তব্যবোধ ও উপলব্ধির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয় জাতি ও রাষ্ট্রকে । প্রজাতন্ত্রের মানবিক নৈতিকতা না থাকলে প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের রণকৌশল নির্ধারণ করা যায় না। সংস্কৃতিকে দরজার বাইরে রেখে অর্থনীতি, রাজনীতি, অগ্রগতি সবকিছু হবে অন্তঃসারশূন্য।
এ ধরনের 'লজ্জিত' ও 'লজ্জার' বিচারবোধ রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকলে এবং পুলিশ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের ভেতর ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ পরম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হলে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ও অনেক মূল্যবান জীবনের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতো। জনগণ রাষ্ট্রের শত্রু নয়, জনগণের জন্যই রাষ্ট্র।
আমাদের রাষ্ট্রে একজন নাগরিক খুন হওয়ার সাথে সাথেই সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয় 'এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা'। দেশের নাগরিক খুন হলেও কী এক অদৃশ্য কারণে রাষ্ট্র তা দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে দেখতে চায় না। এসবই উপনিবেশিকতার ফসল। রাষ্ট্রের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, বেদনা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত শাসকদের স্পর্শ করতে পারে না। ফলে নাগরিকের হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে রাষ্ট্র আত্মতৃপ্তি লাভ করে। যেখানে ‘বিচ্ছিন্ন‘ ঘটনার সংস্কৃতি বিদ্যমান সেখানে 'লজ্জিত' ও 'লজ্জার' স্বীকারোক্তি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।

রাষ্ট্রের নাগরিক খুন হলে তা 'দুঃখজনক' ঘটনা না হয়ে ' বিচ্ছিন্ন ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করলেই কি রাষ্ট্রের দায় মোচন হয়ে যায়? এই উচ্চারণ, এই বয়ান যে রাষ্ট্র থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, রাষ্ট্র থেকে জীবনের মর্যাদা বিচ্ছিন্ন করে দেয় তা শাসক শ্রেণী কোনদিন বিবেচনায় নেয়নি।
আমাদের রাষ্ট্র থেকে মানবীয় উপলব্ধির অন্বেষণ দূর করে দেয়া হয়েছে। হত্যার মতো ঘটনাকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে পরোক্ষভাবে নির্মমতার প্রচন্ড বেদনাকে অস্বীকার করা হয়, আর হত্যাকে সহজলভ্য বিষয় বলে গণ্য করে হত্যার দায়মুক্তি নিতে চায় রাষ্ট্র। এ হত্যা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' -সরকারি এ ভাষ্য হত্যার শিকার পরিবার ও দেশবাসীর মনে যে কত বড় বিপর্যয় নিয়ে আসে, কী নিদারুণ অনিশ্চিয়তা সমাজকে ঘিরে ফেলে তা রাষ্ট্র কোনদিন উপলব্ধি করতে চায়নি।
নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের যে মানবিক আনুগত্য থাকতে হয়, মানবিক দর্শন থাকতে হয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয় তা আমরা ভুলেই গেছি।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সেবকগণের মাঝে জ্ঞান, বিচারবোধ এবং নৈতিকতাবোধের আভ্যন্তরীণ বুনন যে থাকতে হয় তা শাসকগণ স্বীকারই করে না। ফলে সমাজ ক্রমাগত নিষ্ঠুর, নির্মম ও অমানবিক হতে চলেছে। সরকারি দলের অনেকের কুকীর্তি প্রকাশ হচ্ছে, লুন্ঠন প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু দল লজ্জিত হচ্ছে না, লজ্জাকর মনে করছে না। আমাদের চেতনাগত বিপর্যয়ের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে আজকের এই বাস্তবতা।

নাগরিক হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং ন্যায় সঙ্গত বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে অস্বীকার করাই হচ্ছে উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার দর্শন। কিন্তু এক নদী রক্ত পেরিয়েও আমরা আমাদের স্বাধীন দেশের জাতীয় চেতনাকে আজ পর্যন্ত সমাজ চেতনায় রূপান্তর করতে পারিনি।
ডেভিড হিউম বলেছিলেন দার্শনিক হও: কিন্তু সমস্ত দর্শনের মধ্যেও মানুষ হও। কমিশনার নিশারুল আরিফ বলতে চেয়েছেন পুলিশ হও কিন্তু পুলিশের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে মানুষ হও।
আমরা যা হই সকল কর্মকাণ্ডের মাঝেও যেন মানুষ হই, এ ধরনের বার্তা সমাজকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
এবার থাইল্যান্ডে জরুরি অবস্থা জারি করার পরও বিরাট বিরাট মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রানীর গমনপথেও বিক্ষোভ হয়েছে কিন্তু একটি গুলিও ছোড়া হয়নি। পুলিশের গুলিতে কেউ প্রাণ হারায়নি। জরুরি অবস্থায় চারজনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। তারপরও অব্যাহত সমাবেশ মিছিল বিক্ষোভ অবস্থানে গুলি না করে, রক্তে রাজপথ রঞ্জিত না করে বরং জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করে বলেছে, ক্ষমতা দখল করার পর সরকার জাতীয় পুনর্মিলন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু সমাজে বিভেদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু অনেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু এখন তারা প্রতিবেশীদের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তারা থাই জনগণের কাছে সুখ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু এখন কম লোক হাসছে। তারা যে সংবিধান তৈরি করেছে তা এখন জাতীয় মাথা ব্যথা। সরকার ব্যর্থ হয়েছে, সরকার তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিবাদকারীরা আরো বলেছে, বর্তমান বিক্ষোভ থাইল্যান্ডের সামাজিক কাঠামোকে ভীত করে তুলছে, এটা আমাদের পরিবারের প্রথা ভেঙে দিয়েছে। এতকিছুর পরও আমরা এখন রাস্তায় রয়েছি। আমাদের জীবনযাত্রা এত খেলনা নয় যে -সরকারের যা ইচ্ছা তাই খেলতে পারেন বা উপেক্ষা করতে পারেন বা ফেলে দিতে পারেন।

প্রতিবাদকারীরা বলেছে দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন যে, আমরা আজ আমাদের ভয়েস পুনরায় উত্থাপন করতে এসেছি। আমরা মনে করি না আপনি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, হাতের ছাতা এবং স্মার্টফোনগুলো কেবলমাত্র আপনার দাঙ্গা এবং জলকামানের বিপরীতে রয়েছে।
সরকার দেশটাকে জটিল করে তুলেছে কিন্তু আমাদের অধিকার জটিল নয়। সরকার ভয়কে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করে কিন্তু ভালোবাসাকে নয়। সরকার চিরকাল ভয় দেখিয়ে শাসন করতে পারবে না। দেশ মানে সরকার নয়- দেশ মানে জনগণ।

আমরা আশা করি একবারের জন্যও হলেও সরকার আমাদের কথা শুনবে। পুনর্মিলনের সুযোগ এখনও রয়েছে। আমরা এখনো সামাজিক ফেব্রিককে সংশোধন করতে এবং পুনরায় বুনতে পারি। জাতির আত্মার মূল্য দিতে এই সংগ্রাম নয় এই সংগ্রাম শুধু পুনর্গঠনের।
এই উচ্চতর আদর্শের জন্য আমরা আমাদের জীবন এবং আমাদের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছি।
থাইল্যান্ডের জনগণের এই বক্তব্যকে স্তব্ধ করার জন্য সরকার নৃশংসতার আবহে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি, ক্ষমতার দম্ভে বিচারবোধকে বিসর্জন দেয়নি, সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে রাষ্ট্রকে বিপদজ্জনক অবস্থানে উপনীত করেনি।
আর আমাদের মতো দেশে আইন ভঙ্গের অজুহাতে গুলি করে মানুষ হত্যা করার মতো ঘটনায় রাষ্ট্র ন্যাক্কারজনক ভূমিকা গ্রহণ করতো। সরকারের প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতার কথা বলে মিছিল সমাবেশ করে প্রতিবাদী ভুমিকা গ্রহন করলে জনগণকে 'ষড়যন্ত্রকারী' ও 'রাষ্ট্রদ্রোহী' হিসেবে আখ্যায়িত করতো।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রের স্থির নিশ্চিত নৈতিক মনোভাব বা নীতিমূলক রাজনৈতিক অনুশাসন এখনো গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র একটা 'উত্তম নৈতিকতা', 'জীবন' ও 'অধিকার' সুরক্ষার মত একটি প্রত্যয় আজ পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে পারেনি। আমরা দ্রুত গতিতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছি। লোভ চরিতার্থতার জন্য রাষ্ট্র নয় - এটাও আমরা ভুলতে বসেছি।

যে রাষ্ট্র নাগরিকের জীবন, জীবনের ইতিবাচক দিক এবং জীবনের মহৎ দিক উপলব্ধি না করে আইনের অজুহাতে বা স্থিতিশীলতার অজুহাতে জীবন বিপন্ন করার উপায় খুঁজে সে রাষ্ট্র আর নাগরিকের থাকে না । রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি স্তরে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৃশংসতা বিরাজমান কিন্তু কোন ক্ষেত্রে আমরা লজ্জিত হচ্ছি না বা লজ্জাকর মনে করছি না। আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেও দায় স্বীকার করছি না। আমরা সকল ক্ষেত্রে সর্বদাই কেবল সফলতার বুলি আওড়াচ্ছি।
একটি যুক্তিনির্ভর নৈতিক আদর্শ আমরা গত ৫০ বছরে চর্চা করতে পারিনি। নৈতিক আদর্শ যে রাষ্ট্র বিনির্মাণের ভিত্তি আমাদের শাসকগণ কোন বিবেচনায়ই তা গ্রহণ করেনি।
এই যে আমাদের অবক্ষয়, এই যে আমাদের বর্বরতা, এই যে আমাদের অসভ্যতা তা থেকে মুক্তির জন্যও যে নৈতিকতা পুনরুজ্জীবন দরকার তাও আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না। বরং এই অসভ্যতার পুর্নজন্মকেও আমরা অগ্রগতির সোপান হিসেবে বিবেচনা করছি। ফলে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের চেতনা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন বিলুপ্তির পথে।

সভ্যতার বাস্তব অবস্থা নিয়ে আমাদের আত্মপ্রতারণার প্রশ্নে আলবার্ট সোয়াইটসার বলেছেন, এক শক্তিশালী জলের নিচে আমরা ভয়ংকর ঘূর্ণিপাকের কিনার ধরে ভাগ্যের তরী নিয়ে ভেসে চলেছি; যে পার্শ্ব গতিধারায় আমরা সেই তরীকে ভেসে যেতে দিয়েছি তা থেকে তাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য,তাকে উদ্ধার করার কোন আশা যদি পূরণ করা যায়- তাহলে বিশাল -বিপুল আয়তনের উদ্যোগের প্রয়োজন পড়বে।

আমাদের রাষ্ট্র নৈতিকতা থেকে ছিটকে পড়েছে। সুতরাং বিরাট ও বিপুল আয়তনের উদ্যোগের প্রয়োজন, নতুবা আমাদেরকে অতি উচ্চ মূল্য দিতে হবে।

লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গীতিকার
২৯.১০.২০২০.
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status