প্রথম পাতা

বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে?

আলতাফ হোসাইন

২২ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়ে। একবার বাড়লে আর কমে না। দাম বাড়ানোর সময় সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে না। কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই আলোচনায় আসে সিন্ডিকেট। তবে এই সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। সম্প্রতি চাল, তেল, পিয়াজ ও আলুসহ বাজারে অনেক পণ্যের দাম লাগামহীন। এতে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ ক্রেতাদের। দ্রব্যমূল্য নিয়ে চারপাশে হৈ চৈ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ পণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে। প্রশ্ন হলো বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ নিলেও তা তেমন কার্যকর হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা কমিশন করে হলেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে এর মূলত কিছু কারণ আছে। বাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়েছে তা নয়। এখানে মূলত কারসাজি আছে। এটা সব সময় হয়ে আসছে, কখনো কমে না। মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট করে কিছু জরিমানা করা হয়। কিন্তু এতে সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফায়দা হয় না। মজুতগত এবং সিন্ডিকেটের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এখন এর জন্য দরকার বাজার মনিটরিং। এটা করা উচিত সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার। এর ওপর এখন করোনার সময় ট্রান্সপোর্ট খরচটা বিভিন্ন জায়গায় বেড়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে আবার চাঁদাবাজিও চলে। এছাড়া টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, মহামারির সময় অনেকের আয়ের উৎস নেই। অনেকের বেতন-ভাতা কমে গেছে। দেখা যাচ্ছে একটা পরিবারে একজন কর্ম করে, তার আয়-রোজগারও কমে গেছে। এ অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বেশি পড়েছে। এজন্য নিত্যপণ্যের বাজার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এটা যেন আরো উপরে উঠে না যায়। সরকার পণ্যের দর নির্ধারণ করে দিলেও কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ট্রেডবডি বা বিভিন্ন সমিতি আছে। মালিক সমিতি, রিট্রেইলার সমিতি। এরা প্রত্যেকে কিন্তু বিগ এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। সরকারও এদের ওপরে বিভিন্ন কারণে ডিপেন্ড করে। সরকারি লোক, সরকারি কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়ে থাকে। এ কারণে তারা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এখন দরকার হলো মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারকে খুব শক্ত একটা অবস্থান নিতে হবে। শুধু বাজারে একটু অভিযান, দু’একজন খুচরা ব্যবসায়ীকে জরিমানা- এগুলো করে কোনো লাভ হবে না। মূল সিন্ডিকেটধারীদের শক্ত হাতে ধরতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দিতে হবে। এর জন্য তারা আবার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সেটাও শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এখানে সরকারের দুর্বলতা আছে। তাদের দুর্বলতা এবং সুশাসনের অভাবেই এরা এসব করতে সাহস পায়।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বা এটা খুবই কঠিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। এর জবাবে সাবেক এই গভর্নর বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থিওরি মানেতো সব অবাধে চলবে তা নয়। এটাকে অবশ্যই কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে। কোল্ড স্টোরে যদি একটা পণ্য ২৩ টাকা হয় আপনি সেটা বাইরে গিয়ে ৫০ টাকায় কেন বিক্রি করবেন। এগুলোকে নজরদারি করতে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে একেবারে ছেড়ে দেবেন তা উচিত না। আরেকটা বিষয় হলো বাংলাদেশে যদি টিসিবি  ভালো থাকতো বা অন্য সরকারি সংস্থাগুলো যদি ভালোভাবে কাজ করতো তাহলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কিছু নয়। টিসিবিতো নামে মাত্র।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিুজল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট থাকে এটা ঠিক। কিন্তু সরবরাহ না বাড়ালে শুধু দর নির্ধারণ করে দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এই মুহূর্তে পণ্যের দাম কমাতে হলে অবশ্যই সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। সরকার বলছে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন পণ্যের সংকট। সরকারের তথ্য যদি সত্য হয় তবে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন?

এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন এবং বাস্তবে এটা করা যায় না। মন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন চেষ্টা করে, তবে বাস্তবে এটা করা যায় না। বাজারে চাহিদা ও তাদের ব্যবসায়ী নানান কারসাজির কাছে- এটা করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি না।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মানবজমিনকে বলেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা সহজ নয়। সাধারণত আমরা যেটা জানি, যখন চাহিদা কম থাকে এবং সরবরাহ বেশি থাকে তখন পণ্যের দাম কমে। অপরদিকে, চাহিদা বেশি থাকলে সরবরাহ কম থাকলে মূল্য বাড়ে। এখন সাম্প্রতিককালে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। বন্যায় ফসলি জমির ক্ষতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে সরবরাহ কমেছে। উৎপাদনও কমেছে। এ কারণে শাক-সবজির দাম বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা তো আর কমেনি, সে কারণে শাক-সবজির দাম বেড়েছে। আর শাক-সবজির দাম বাড়ায় বাজারে আলুর চাহিদা বেড়েছে। যদিও সরকারি হিসেবে চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন অনেক বেশি। এরপর করোনাকলে আলু ত্রাণ হিসেবেও বিতরণ হয়েছে। তবু সরকারি হিসাব যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আলুর দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

ক্যাব সভাপতি আরো বলেন, যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকে, কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে সেগুলোরও দাম বাড়ানোর প্রবণতা থাকে। এটা তারা বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় করে থাকে। এর প্রেক্ষিতে সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে দুই একটি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তারা কিছু শুনছে না। সেজন্য আমি প্রথমেই বলেছি, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এখন এ ক্ষেত্রে সরকারকে যেটা করতে হবে, সত্যিকারেই যদি কোল্ড স্টোরে আলুর পর্যাপ্ত মজুত থেকে থাকে, তাহলে যারা এই মজুত ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া এবং বিক্রি করতে বাধ্য করতে হবে। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তখন মূল্য স্বাভাবিক হবে। কিন্তু এমন যদি হয় যে, কিতাবে আছে, বাস্তবে নাই তাহলে এসব করেও কোনো কাজ হবে না।

বাজারের এমন অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। বাজারে অভিযানও চালানো হয়। ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে গোলাম রহমান বলেন, সব রোগের চিকিৎসায় যেমন একই ওষুধ নয়, তেমনি সব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ একই ব্যবস্থায় হতে পারে না। মূল কথা হলো- সরবরাহ বাড়াতে হবে। তাহলেই দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে, স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু যারা মজুত ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ধরে শাস্তি দেয়া হোক, জেলে দেয়া হোক, তাহলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? তারা তো সরকারের চেয়ে শক্তিশালী না। আসলে সরকার যদি কাউকে আইনের আওতায় না আনতে চায় তখনই সংকট সৃষ্টি হয়। কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এ ক্ষেত্রে দু’টি কারণ থাকতে পারে; হতে পারে এখানে সরকারের তথ্য ভুল, অথবা সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী না। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নাই। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয় না- তা নয়। বাজারে অভিযান চালানো হয়, ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়। কিন্তু সার্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কেবল শাস্তি দিয়ে কাজ হয় না। এটার জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা অভিজ্ঞ সরকারের তারা সবই জানে। এটা শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এটা ঠিক, তবে সরকার চাইলে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status