বিশ্বজমিন

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন

সুইডেনের ব্যতিক্রমী কোভিড কৌশলের মূল শিক্ষা

মানবজমিন ডেস্ক

১৯ অক্টোবর ২০২০, সোমবার, ৯:৫৭ পূর্বাহ্ন

নিজের যুক্তির পক্ষে কোনো ছোট দেশের উদাহরণ ব্যবহার করার একটা চমৎকার দিক হচ্ছে, দেশটিতে আসলে কী ঘটছে তা আপনার প্রতিপক্ষের জানার সম্ভাবনা কম। হয়তো এ কারণেই, কোভিড-১৯ মোকাবিলা করার সঠিক উপায় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেখানে মাত্র ১ কোটি ৩ লাখ জনসংখ্যার দেশ সুইডেনের নাম অসংখ্যবার উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, স্বাধীনতাপ্রেমী সুইডিশরা মাস্ক-মুক্ত ও শিথিল-লকডাউন আরোপের কৌশল অবলম্বন করেছে। এরফলে অর্থনীতিতেও ধস নামেনি, আবার হার্ড-ইমিউনিটি (গণ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা) অর্জন করা যায়। অনেকে বলেন, সুইডেনের এই সাফল্য বামপন্থীদের প্রতি তিরস্কারের সামিল, কেননা এই বামপন্থীরা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে মানুষের স্বাধীনতায় লাগাম টানতে উদগ্রীব।
সুইডেনের কোভিড মোকাবিলার কৌশল থেকে অবশ্যই কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে। তবে এই শিক্ষা স্বাধীনতার শিক্ষা নয়; বরং কীভাবে লাভ ও ক্ষতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে কৌশল প্রণয়ন করা যায়, তারই শিক্ষা। বৃটেনের দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে সুইডেনের কোভিড ১৯ মহামারি মোকাবিলার কৌশল নিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে।
সরকারের আকার ছোট করার পক্ষের লোকজন যখন সুইডেনকে আদর্শ মানেন, তখন তার চেয়ে অদ্ভুত আর কিছুই শোনায় না। কারণ, সুইডেন বিশ্বে প্রগতিশীলতার এক বাতিঘর। সামাজিক খাতে ব্যয়ের হিসাবে ওসিইডি’র তালিকায় তাদের অবস্থান সপ্তম- জার্মানিরও আগে।
নব্য রক্ষণশীল সুইডেনভক্তদের এ দাবি অবশ্য ঠিক যে, করোনার প্রথম দফা সংক্রমণে দেশটির সরকার মহামারি মোকাবিলায় হালকা পদক্ষেপ নিয়েছিল। বড় ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা ও ব্যাপক পরিমাণে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হলেও, কঠোর লকডাউনে যায়নি দেশটির সরকার। কিন্তু ওই পদ্ধতি খুব একটা সফল হয়নি। করোনায় প্রতি এক লাখে দেশটিতে গড়ে মারা গেছেন ৬০ জন। পার্শ্ববর্তী নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের তুলনায় (যারা পুরোপুরি লকডাউন জারি করেছিল) এ মৃত্যুহার ১০ গুণ বেশি। সুইডিশদের 'স্বাধীনতা' তাদের অর্থনীতিকেও বাঁচাতে পারেনি। যদিও মৃতদের অনেকেই ছিলেন ষাটোর্ধ্ব ও কাজ না করা ব্যক্তি, এই অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদন কমে গিয়েছিল ৮.৩ শতাংশ— যা অন্যান্য নর্ডিক দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি খারাপ।
তবে এটা ঠিক যে, বৃটেন, ফ্রান্স ও স্পেনে মতো করোনার দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ সুইডেনে দেখা যায়নি। কিন্তু এ বিষয়টি বাদ দিয়ে বিবেচনা করলে, সেপ্টেম্বরে রাজধানী স্টকহোমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেড়ে গেছে (তবে সার্বিক বিচারে এই সংখ্যা এখনো কম)। দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ মোকাবিলায় সুইডেনের কৌশল জার্মানির কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অনেকে দাবি করেন, সুইডেন হার্ড-ইমিউনিটি অর্জন করতেই হালকা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হার্ড-ইমিউনিটি অর্জন করা সুইডেনের এই কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল না। দেশটিতে এখনো বহু মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। বরং, দেশটি ব্যাপক পরিসরে পরীক্ষা ও কনট্যাক্ট ট্রেসিং বাড়িয়েছে, যাতে করে সংক্রমণ আগেভাগে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত স্পষ্ট বার্তা ছড়ানো হচ্ছে যে, এই পদ্ধতি টেকসই, কেননা এতে জনগণ স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। সকল জায়গায় এ পদক্ষেপগুলোই করোনা মোকাবিলা কৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
নতুন সুইডিশ নীতিমালা থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় সেটি লিবার্টেরিয়ান বা উদারবাদী শিক্ষা নয়। বরং, শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, সরকার কীভাবে লাভ-ক্ষতির অংক কষে সিদ্ধান্ত নেয়। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনে কেউ যখন করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়, তার পরিবারের প্রত্যেককে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়। কিন্তু স্কুলশিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে— কারণ, সরকার বলছে, শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দি করে রেখে যে লাভ হবে, তা তাদের শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির তুলনায় তুচ্ছ।
ঠিক তেমনি, সুইডেনে কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ পাঁচ থেকে সাতদিন, যেখানে অন্যান্য জায়গায় তা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। দ্বিতীয় সপ্তাহে কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যান্যদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা কম থাকে ও তা দিনদিন আরো কমে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদীন আইসোলেশনে থাকায় মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। সরকার মনে করছে, দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটার ঝুঁকি কিছুটা থাকলেও, দীর্ঘদিন একাকীত্বে বন্দি অবস্থায় থাকলে রোগীর স্বাস্থ্যের যেই ক্ষতি হবে, তা আরও বড় ক্ষতি। এভাবেই লাভক্ষতির হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সুইডেন।
সুইডেনের সমাজে সরকারের প্রতি জনগণের বিশ্বাস অত্যন্ত উঁচু-পর্যায়ের। জনগণ ও নাগরিকরা নিয়ম মেনে চলতে অভ্যস্ত। তারপরও দেশটির করোনা মোকাবিলার কৌশল এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে যে, ভাইরাসটি দীর্ঘসময় থাকবে। কিন্তু জনগণকে অত্যধিক ত্যাগ স্বীকার করতে বললে তাদের মধ্যে আনুগত্য হ্রাস পাবে। আর রোগটিরও বিস্তার ঘটবে। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদের কথা ভেবে সহনীয় মাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সুইডেন।
আর মাস্ক না পরার বিষয়টা কী? সুইডেনের নব্য ভক্তরা স্টকহোমে মাস্কহীন লোকজনের জমায়েত দেখে সেটাকে স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু সুইডেনের নীতিমালার ভিত্তি তা নয়। দেশটির সরকারি বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে তেমন একটা সহায়ক নয়। তা ছাড়া সরকারের নেওয়া অন্যান্য পদক্ষেপগুলো বেশ ভালোভাবেই কাজ করছে।
এটি সত্য যে এই ইস্যুতে সুইডেন সমসাময়িক অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ে সন্দেহ নেই যে, সেখানে যদি করোনা ফের হানা দেয়, তাহলে এই নীতিমালায় পরিবর্তন আসবে। কারণ, সুইডেনে সরকারী নীতিমালা বা সিদ্ধান্ত প্রায়োগিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে নেওয়া হয়, অন্ধ আদর্শ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status