শেষের পাতা

মানবজমিনকে আর্মেনিয়ান এমপি নারেক মার্কেচান

আজারবাইজান যুদ্ধটিকে মুসলিম দেশগুলোর কাছে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থেকে দেখাচ্ছে

তারিক চয়ন

১৯ অক্টোবর ২০২০, সোমবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

পূর্ব ইউরোপের নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে তিন দশকের বিরোধ আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার। দুই দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ওই এলাকা আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনী দখল করে নিলেও দু’দেশই এটিকে নিজেদের  অংশ বলে দাবি করে আসছে। ১৯৮৮-৯৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এলাকাটি আজারবাইজানের বলে স্বীকৃত হলেও পরিচালনা করে জাতিগত আর্মেনীয়রা।
পুরনো সংঘর্ষ আবার নতুন করে শুরু হয় গত ২৭শে সেপ্টেম্বর। নতুন এ যুদ্ধে শত শত মানুষ মারা গেছে, লাখো মানুষ হয়েছে বাস্তুচ্যুত। সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য দেশ দু’টি যখন একে অপরকে দায়ী করছে তখন মানবজমিন প্রতিনিধি তারিক চয়নের সঙ্গে আর্মেনিয়া থেকে ফোনে কথা বলেন আর্মেনীয় সংসদ সদস্য নারেক মার্কেচান। যিনি ক্ষমতাসীন সিভিল কন্ট্রাক্ট পার্টি থেকে নির্বাচিত।

মানবজমিন: এবারের উত্তেজনার সূত্রপাত কীভাবে? নেপথ্যে কি ছিল?
নারেক: ২০২০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ভোরে আজারবাইজান আকাশপথে এবং কামানযোগে হামলা চালায়। পাশাপাশি স্টেপানকোর্টের রাজধানীসহ নাগর্নো-কারাবাখের যোগাযোগের পুরো লাইন ধরে পদাতিক আক্রমণ চালায়। আক্রমণটি যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে, আজারবাইজানের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও তা নিশ্চিত করেছে। তদুপরি, এটা স্পষ্ট যে জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত আজারবাইজান-তুরস্কের দুই সপ্তাহব্যাপী স্থল এবং আকাশপথে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ সেপ্টেম্বরের আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে করা হয়েছিল।

মানবজমিন: কত সংখ্যক মানুষ এবারের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে? ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটাই বা কেমন?
নারেক: আমাদের সরকারি সূত্র মতে, প্রায় ৬৩৩ জন আর্মেনীয় সেনা এবং ৩৪ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। ক্ষতির পরিমাণ অনেক। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই আজারবাইজান রাজধানী স্টেপানকোর্ট এবং এর বিভিন্ন অবকাঠামোসহ শহর ও গ্রামগুলোতে বোমাবাজি করে আসছে।

মানবজমিন: আর্মেনিয়া কেমন জবাব দিয়েছে?
নারেক: নাগর্নো-কারাবাখের বিরুদ্ধে আজারবাইজানের আক্রমণ আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইতিমধ্যেই ১২ই জুলাই আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম আজারবাইজানের বাহিনী কীভাবে আর্মেনিয়ান প্রদেশের তাভুশ আক্রমণ করেছিল, যখন তারা অনেক বেসামরিক স্থানসহ একটি টেক্সটাইল কারখানাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল যা করোনার সংক্রমণ রুখতে মাস্ক তৈরি করছিল। আজারবাইজানের আগ্রাসন রুখতে এবং দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলকে অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদ থেকে দূরে রাখতে নাগর্নো-কারাবাখের সেনাবাহিনী তুরস্ক-আজারবাইজানের সন্ত্রাসবাদী-ভাড়াটে সামরিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল এবং আছে। তবে, আর্মেনিয়ার প্রতিক্রিয়া কেবল আত্মরক্ষার প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রয়োজনে আর্মেনিয়ান বাহিনী শত্রুদের প্রতিরোধ করতে কৌশলগত আক্রমণ পরিচালনা করছে।

মানবজমিন: কিন্তু আপনাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই আর্মেনিয়া কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন, এমন খবরও বেরুচ্ছে আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যমে...
নারেক: আমি মনে করি না আর্মেনিয়া কোণঠাসা হয়েছে বা হবে। এ ধরনের ভুল তথ্য বা সংবাদ আজারবাইজান ছড়াচ্ছে। এটা যুদ্ধের একটা অংশ এবং আমরা এটি ভালোই বুঝি। আমি মনে করি, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা হয়েছে। তাই আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিকোল পশিনিয়ানের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি: ‘...তবে আমাদের সবার জানা দরকার যে আমরা কঠিন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন। এটি হতাশার বা হতাশাজনক বিবৃতি নয়। আমি এই তথ্যটি সরবরাহ করছি কারণ আমরা আজারবাইজান থেকে পৃথক, আমাদের জনগণকে সত্য বলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওরা নিজেদের হাজার হাজার ভুক্তভোগীর সত্যকে গোপন করে এবং আমাদের অনুমান, সামরিক সরঞ্জামে তাদের ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লোকসান হয়েছে।’ সুতরাং, আমি মনে করি এটি স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলছিলেন, কোণঠাসা হবার কথা নয়। দুটো নিশ্চয়ই ভিন্ন বিষয়।

মানবজমিন: রাশিয়ার উদ্যোগে দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও উত্তেজনা কমছে না কেন?
নারেক: ঠিক বলেছেন। ৯ই অক্টোবর ২০২০ আর্মেনিয়া,  আজারবাইজান এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যৌথ ঘোষণায় রেডক্রস কমিটির মধ্যস্থতায় এবং মানদণ্ড অনুসারে যুদ্ধাপরাধী, বন্দি ও নিহতদের লাশ বিনিময়ের জন্য একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেছিলেন। আর্মেনিয়ান পক্ষ তার সেনাবাহিনীকে গুলি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল এবং মানবিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছিল। তবে আজারবাইজান দ্বিগুণ উৎসাহে শান্তিপূর্ণ জনবসতিগুলোয় আক্রমণ এবং বোমাবাজি চালিয়ে গেছে। চুক্তির ঠিক পরদিনই তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজারবাইজানের রাজধানী বাকু সফর করেন এবং এরপর মানবিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন আরো নৃশংস হয়ে ওঠে। তুরস্ক যুদ্ধবিরতি এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে আসার প্রাথমিক বাধা হিসাবে কাজ করেছে।

মানবজমিন: আর্মেনিয়া এখন কি করতে চাচ্ছে?
নারেক: আমাদের মেনে নিতে হবে যে নাগর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ানরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নাগর্নো-কারাবাখ দ্বন্দ্বে তুরস্কের হস্তক্ষেপ ১৯১৫ সালের আর্মেনিয়ান গণহত্যা (যা বহু দেশ দ্বারা স্বীকৃত) চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পূর্ণ।
তুরস্ক নগ্নভাবে আজারবাইজান এবং তার গণহত্যা নীতিকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। তুরস্ক সমর্থিত নাগর্নো-কারাবাখের জনগণের বিরুদ্ধে চলমান জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং আজারবাইজানের সর্বাত্মক যুদ্ধ বন্ধ করার একমাত্র কার্যকর উপায় হলো তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রতি বিশ্ববাসীর নিন্দা প্রকাশ এবং নাগর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান। সুতরাং, নাগর্নো-কারাবাখের স্বীকৃতি কেবল আর্মেনিয়া নয়, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীন থাকা উচিত নয়। উদাসীনতা- মানবতাবিরোধী অপরাধের পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। আমরা গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া জাতি হিসাবে, গণহত্যা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কণ্ঠের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিই। সুতরাং আমরা আমাদের ঐতিহাসিক স্বদেশভূমির জন্য লড়বো, অস্তিত্ব সংকট থেকে মুক্তি পেতে লড়বো এবং শেষ পর্যন্ত আমরা নাগর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্রকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় যদি নাগর্নো-কারাবাখের শান্তি ও নিরাপত্তা চায় তবে তাদের উচিত স্বাধীনতার এই স্বীকৃতি প্রদান করা। অথবা আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিকোল পশিনিয়ান যেমনটি বলেছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে কারাবাখ বিরোধের একটি সমাধান রয়েছে: প্রতিকারে বিচ্ছিন্নতার নীতি।’

মানবজমিন: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এ যুদ্ধে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও সক্রিয়...
নারেক: তা ঠিক। শীর্ষস্থানীয় ও স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়া থেকে স্থানান্তরিত (তুর্কি পৃষ্ঠপোষকতায়) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, ইরান, কানাডাসহ অনেক দেশ এটি নিশ্চিত করেছে, নিন্দা জানিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, এটি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। কারণ সন্ত্রাসীরা ভিডিও টেপ এবং ছবি রেকর্ড করে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে নিজেদের প্রচার করেছে। তুর্কি মদতে গড়ে উঠা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং তুর্কি বিশেষ বাহিনী ছাড়াও আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইরত পাকিস্তানি বিশেষ বাহিনী এবং ভাড়াটে বাহিনী রয়েছে। আজারবাইজান এই যুদ্ধকে মুসলিম দেশগুলোর কাছে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থেকে দেখাচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভুল, অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতারণার শামিল। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার সত্যতা প্রমাণ করা এবং অন্য কোনো গণহত্যা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা নৈতিক দায়িত্ব।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status