প্রথম পাতা

ইতিবাচক ধারায় অর্থনীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৭ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। গতি এসেছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর অনেক আগ থেকেই প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক খারাপ অবস্থায় ছিল। তবে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো। গরিব কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য, উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ- এসব উদ্যোগ এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়েছে বলে বিভিন্ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস মতে, করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটবে অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই দ্রুত। আমদানি-রপ্তানি ব্যয়ে ভারসাম্য, রেমিট্যান্সে সাফল্য, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দীর্ঘদিন পর চাঙ্গা হয়েছে পুঁজিবাজার এবং জিডিপি অনুপাতে সরকারি ঋণ কম হওয়ায় অন্য দেশের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার প্রকাশিত আইএমএফ’র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভারতের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে দু’টি কারণে। এর মধ্যে একটি হলো- বড় নোট বাতিল করা। আরেকটি করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা। এ কারণে ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু জিডিপি কমে গেছে। অন্যদিকে জিডিপিতে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। করোনার সময়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতও সচল হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে বড় শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে গরিব কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কারণ, এখনও কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখনও বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস কৃষি। কৃষকরা যদি খাদ্য উৎপাদন না করতো, তাহলে বড় বিপদ হতো।

স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বৈশ্বিক গবেষকরা গত মাসে বলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণ সবচেয়ে দ্রুত গতিতে হবে। অর্থনৈতিক সূচকগুলো ইতিবাচক হওয়ায় তা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে শক্তিশালী করবে। ফলে খুব শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত করোনা পরিস্থিতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার কারণ হিসেবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে সরকারের সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপগুলোকে চিহ্নিত করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরেই অর্জিত হয়েছে। করোনার মধ্যেও দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫৫ ডলার।

তারা বলেন, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। পুঁজিবাজার নিয়ে যে আশা করা হয়েছিল তা নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে। আমদানি-রপ্তানি চাহিদার তুলনায় বেশি। আমদানি-রপ্তানি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট আগে ছিল নেগেটিভ, যা এখন পজিটিভ হয়েছে। রিজার্ভ সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড, মাছ উৎপাদনে রেকর্ড, বন্যার মধ্যেও সবজি রপ্তানি হচ্ছে। তাই এডিবি বা বিভিন্ন সংস্থা যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তার থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাংলাদেশের বেশি হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।

প্রসঙ্গত, করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সব পক্ষের প্রচেষ্টার ফলে। এই করোনার মধ্যে সবাই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বিসিএস’র হিসাব করোনাভাইরাসের মধ্যেও গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশ অর্জন হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয়ও ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে ২০৬৪ ডলারে উঠেছে। এছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গতি পেয়েছে। আইএমইডি’র তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে এডিপি কার্যক্রমে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।

মানুষের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। সড়কে আগের মতোই যানজট দেখা যাচ্ছে। আগের মতো চায়ের স্টল, কফি শপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও। আমদানি করা নতুন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে। আবার অনেক জাহাজ রপ্তানি পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়েও যাচ্ছে বিদেশে। এছাড়া কৃষি খাতে করোনার কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রধান প্রধান ফসল, গবাদিপশু, মাছের উৎপাদন ও বিপণনে সমস্যা হয়নি। ফলে অর্থনীতি জেগে উঠছে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার পর সুযোগ আসছে। এখন কিছু নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদন, বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে আগে ভাবতে হবে। আমাদের নতুন করে রপ্তানি আদেশও আসছে। যারা কাজ হারাচ্ছেন তাদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। সবদিক বিবেচনায় আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার মধ্যে গত ঈদে কাঙ্ক্ষিত বিক্রি না হলেও আমরা আবার চালু করতে পেরেছি এটাই আমাদের স্বস্তি দিয়েছে।
বিকেএমইএ’র নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানি খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। সাধারণ ছুটির মধ্যেও কারখানা খুলে দেয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত নেয়ার সুফল এখন রপ্তানি খাত পাচ্ছে।
রেমিটেন্সে রেকর্ড: গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২১৫ কোটি ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল প্রায় ১৪৮ ডলার। একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৭ কোটি ৪১ লাখ ডলার বা ৪৫.৬৪ শতাংশ।
নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ: গত ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩৯.৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি আয়: নতুন অর্থবছরের শুরুতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৪৪ কেটি ৯০ লাখ ডলার। অথচ এই খাতে আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রথম মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩.৩৯ শতাংশ।
বাড়ছে আমদানি: করোনার মধ্যেও আমদানিতে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুন মাসে আমদানিতে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও গত অর্থবছরে আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে লেনদেনে উন্নতি: দীর্ঘদিন ধরে নিস্তেজ পুঁজিবাজারেও গতি ফিরেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জুন মাসের চেয়ে জুলাইয়ে শেয়ার লেনদেন বেড়েছে। সূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার পয়েন্টের ঘরে।
কৃষি ও সেবা খাত: করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে কৃষি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখছে খাতটি। আয় কমে যাওয়ায় শহরত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status