মত-মতান্তর

মত -মতান্তর

মৃত্যুদণ্ড নয়, প্রয়োজন সামাজিক পরিবর্তন

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

১১ অক্টোবর ২০২০, রবিবার, ৫:৩৩ পূর্বাহ্ন

ধর্ষণের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে  সারা দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। কিন্তু বিক্ষোভ প্রতিবাদের লড়াকু পরিসরেও থেমে নেই ধর্ষণ নিপীড়ন। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যা উন্মোচিত হচ্ছে তার চেয়ে আরো বেশি চাপা পড়ে আছে, প্রকাশ পাচ্ছে না। বরং ক্রমাগত বেড়েই চলছে ধর্ষণের মতো অপরাধ। ফলে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধ ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের ব্যর্থতাকে ঢেকে দেয়ার জন্য ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রদানে প্রচলিত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সারা দেশের আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার তীব্র ক্ষোভ প্রশমনের জন্য আইন সংশোধনকেই সরকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নিকট অতীতেও তার প্রমাণ রয়েছে। সরকার জানে একটা ঘটনা নিয়ে কিছুদিন তোলপাড়, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, প্রতীকী মঞ্চে বিচার, কুশপুত্তলিকা দাহ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ প্রতিবাদী কর্মসূচী পালিত হয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দেয়া হয়, যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য  সরকার বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করে। তারপর সব চাপা পড়ে যায়। সুতরাং আইন সংশোধনের নামে মূল সমস্যাকে পাশ কাটানো এবং আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়কে স্তিমিত করার সরকারি অপকৌশল বারবার জয় লাভ করছে। হত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠনসহ জনগণের কোন সংকটের সমাধান হচ্ছে না।


এবারও ধর্ষণ বিরোধী সমাবেশ থেকে বিভিন্ন দফা আদায়ে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। এ সকল  দফায় নারীর প্রতি সহিংসতায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করার জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়েছে। সরকার কোন ক্ষেত্রে 'ব্যর্থ' হয়েছে এই আত্মোপলব্ধি-আত্মসমালোচনা সরকারের নেই। দুর্নীতি, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নৈতিক অবক্ষয়ে রাষ্ট্র ধ্বংসের শেষ সীমানায় কিন্তু সরকার মনে করে তারা সকল ক্ষেত্রে সফল। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত একটি রাষ্ট্রে নৈতিকতা, মানবতা ও গণতন্ত্র উচ্ছেদ হয়ে যাবে এটা কল্পনাও করা যায়নি। সর্বোচ্চ শাস্তি আইনে থাকলেই অপরাধ কমে যাবে এসব ভাবনা বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বে আর কোথাও নেই।


নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। আর ৯ (২) উপ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী  তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।


ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি মামলার বাইরে গত বছর ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৫৭ জন নারীকে, আর গত নয় মাসে হত্যা করা হয়েছে ৪৩ নারী-শিশুকে। ধর্ষণে যাবজ্জীবন এবং ধর্ষণের ফলে মৃত্যুতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ও আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। ফলে যতগুলো ধর্ষণের বিচার হয়েছে সেগুলোতে মাত্র তিন শতাংশ সাজা হয়েছে বাকি ৯৭ শতাংশ সাজা পায়নি। ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো অপরাধ কমাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কার্যকর প্রয়োগের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের দুটি রিটের আদেশে ২৪ দফা নির্দেশনা চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে এ রাষ্ট্রে।


উক্ত রায়ে ধর্ষণ মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন, মুলতুবি ছাড়া শুনানি গ্রহণ, সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তার নিশ্চিতে মনিটরিং কমিটি গঠন, অফিশিয়াল সাক্ষী হাজির না হলে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বেতন বন্ধের আদেশসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশনা আদালত দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে অপরাধীরা বিশ্বাস করে আইন তাদের বেলায় কার্যকর হবে না। আমাদের সমাজে যারাই রাজনীতির ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করে তারাই বিশ্বাস করে আইনের হাত তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না।

সুতরাং নতুন আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেই আইনের কার্যকর প্রয়োগ হবে বা আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার আগ্রহী হয়ে ধর্ষণ হত্যা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে এমন কোন বাস্তবতা নেই।


সমাজে যে ধরনের নৃশংসতা ও হিংস্রতা বিস্তার লাভ করছে, যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে, পারিবারিক মূল্যবোধ যেমন লন্ডভন্ড হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতি যেভাবে ধ্বসে পড়েছে  সেসব বিষয় নিয়ে আমাদের কোন শঙ্কা নেই। কীভাবে শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, কীভাবে মাদক যুব সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে, কীভাবে ছাত্র যুবকরা বিপথগামীতার দিকে ধাবিত হচ্ছে,  কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়ছে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কোন ভাবনা নেই। সংস্কৃতির গতি প্রকৃতি নিয়ে আমাদের কোনো মূল্যায়নও নেই। শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ অর্জিত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল করার কেউ নেই। সমাজ জ্ঞানভিত্তিক হচ্ছে কিনা  তা আমাদের বিবেচনায় নেই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, জনগণের নৈতিক মানের উচ্চতা, তীক্ষ্ণ বিচারবোধের ক্ষমতা, বুদ্ধি প্রসারের ন্যায় গুণাবলী এবং আইনের শাসন ও গণতন্ত্র না থাকলে একটি রাষ্ট্রের বিকাশ ক্রমাগত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।  

বাংলাদেশে যে কোন অপরাধের প্রতিকারে মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মৃত্যুদণ্ড যেন আমাদের সমাজের জন্য অনিবার্য। মৃত্যুদণ্ডই যেন সমাজকে অপরাধমুক্ত করার একমাত্র পথ। মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কার্যকর করতে পারলে সমাজে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে- এই ধারণা আমাদের মধ্যে অনেকেরই। কিন্তু আজকের বিশ্বে বহু রাষ্ট্র রয়েছে যারা মৃত্যুদণ্ডকে চিরকালের জন্য বিদায় দিয়েছে, বিনিময়ে সে সকল রাষ্ট্রে অপরাধের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও পুলিশের কর্মক্ষেত্র একেবারে সীমিত হয়ে পড়ছে এবং কারাগারগুলোতে কয়েদির সংখ্যাও শূন্য হয়ে পড়েছে।  


আজ যেখানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের সরকার মৃত্যুদণ্ডকেই একমাত্র করণীয় মনে করছে। এই একটি বিষয় দিয়েই বিশ্ব নৈতিক চিন্তার জগত এবং আমাদের চিন্তা ও মননের পার্থক্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। মৃত্যুদণ্ড কোন সমাজকে নৈতিক ও মানবিক করতে পারে না। এটা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী কোন সমাধান নয়। ভোগের সংস্কৃতি ও লুণ্ঠনের সংস্কৃতি অক্ষত রেখে সমাজকে অপরাধমুক্ত করা অসম্ভব।


উচ্চতম মানবিক সংস্কৃতি ছাড়া এবং উচ্চতম নৈতিক জগত সৃষ্টি ছাড়া মানুষের কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়না। ঘুণে ধরা সংস্কৃতি পরিবর্তন করে গভীর মূল্যবোধের সংস্কৃতি লালন করতে হবে। উপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় তা সম্ভব নয়। এজন্যই সর্বপ্রথম প্রয়োজন স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন কাঠামো প্রবর্তন করা।  লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মত সমাজিক অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন মানবিক উচ্চতম বোধ সম্পন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। নৈতিকতা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছ থেকে সুশাসন আশা করা বাতুলতা মাত্র।


সুতরাং আইনে মৃত্যু দণ্ডের মত নির্মম শাস্তি নির্ধারিত হলেই সমাজ অপরাধমুক্ত হবে না। সমাজ অপরাধ মুক্ত  হবে  যদি সাম্য মানবিক মর্যাদা সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায়। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর বিকল্প হিসাবে মৃত্যুদণ্ড বেছে নেয়া হবে সমস্যা সমাধানের কার্যকর পন্থা এড়িয়ে যাওয়ার নামান্তর মাত্র।


বিশ্ব বিখ্যাত মনীষী আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষ অনেক অগ্রসর হয়েছে, বিশেষত এ যুগে, কিন্তু নৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ যা অর্জন করেছে তা নিম্নস্তরের। তাই আজ আমাদের প্রযুক্তি আর আমাদের নৈতিকতার মধ্যে সৃষ্ট হয়েছে বড়রকম ব্যবধান। এটা শুধু লজ্জাজনক নয়, বিপজ্জনকও। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষের মর্যাদা অর্জন করা যায় না, তা কেবল নৈতিকতার ক্ষেত্রেই লভ্য। আর তা পেতে হলে লোভ ও আগ্রাসন ত্যাগ করে করুণা ও প্রেম দিয়ে কাজ করতে হবে।

লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গীতিকার
১১.১০.২০২০.
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status