মত-মতান্তর

রিফাত হত্যা মামলার রায়: একটি পর্যালোচনা

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

৪ অক্টোবর ২০২০, রবিবার, ২:৪৩ পূর্বাহ্ন

রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। অভিযুক্ত বাকি ৪ জনকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একজন আবার শুরু থেকেই পলাতক আছে।

অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল: রিফাত শরীফের মূল ঘাতক সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড (২৫) ঘটনার অল্প ক'দিন পরেই পুলিশের সাথে এক বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নয়ন বন্ড ০০৭ নামে এক কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছিল, যেটি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ছিনতাই, মাদক সেবন ও ব্যবসা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, চোরাই মোটরসাইকেল ব্যবসাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল।

যদিও বিচারের রায়ে নিহত রিফাত শরীফের বাবাসহ এলাকাবাসী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, নয়ন বন্ডকে জীবিত গ্রেফতার করা গেলে (যেটা দুর্ভাগ্যবশত ঘটেনি) এ ঘটনার তদন্ত ও বিচার আরও অর্থবহ হতো। জীবিত নয়ন বন্ডকে পাওয়া গেলে একদিকে যেমন এ ঘটনায় মিন্নিসহ বাকিদের কার কী ভূমিকা ছিল তা আরও সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেত, সেই সাথে জানা যেত, একজন প্রয়াত ব্যাঙ্কারের এতিম ছেলে সাব্বির আহমেদ নয়ন কিভাবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডে পরিণত হয়েছিল। ভবিষ্যতে এ ধরণের আসামি যেন এভাবে মারা না পড়ে ও জীবিত ধৃত হয়, সে বিষয়ে বিজ্ঞ আদালত কি বিশেষ কোন নির্দেশনা দিতে পারে?

বিচারের রায়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক, নিহতের স্ত্রী মিন্নিকে মৃত্যুদণ্ড দান। বিজ্ঞ আদালত নিশ্চয়ই হত্যাকান্ডে মিন্নির যোগসাজশের যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে যেটুকু জানা গেছে তা হল, মিন্নির সাথে নয়নের বিয়ে হয়েছিল। মিন্নি তা গোপন করে রিফাত শরীফের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়, কিন্তু বিয়ের পরেও সে নয়নের সাথে গোপনে দ্বৈত সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। কোনভাবে তার স্বামী রিফাত তা বুঝে ফেলে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ হয় এবং মিন্নি ক্ষুব্ধ হয়ে নয়নকে দিয়ে তাকে শায়েস্তা করার ফন্দি আঁটে। পরবরর্তী ঘটনা প্রবাহ তারই ফলশ্রুতি।

যদিও বিজ্ঞ আদালত হত্যাকান্ডে মিন্নির যথেষ্ট সম্পৃক্তততা ছিল বলে বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছে, এখানে কিছু বিষয় বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে:

এক, মিন্নি কেন নয়নের সাথে বিয়ের বিষয়টি গোপন করে রিফাতকে বিয়ে করেছিল? স্বেচ্ছায় না গার্ডিয়ানের চাপে? রিফাতকে পাত্র হিসেবে অধিকতর আকর্ষণীয় বিবেচনা করে? নয়নের সাথে মেয়ের কী পর্যায়ের সম্পর্ক ছিল, তা কি গার্ডিয়ানের জানা ছিল?
দুই, রিফাতের সাথে বিয়ের পরেও মিন্নি কেন নয়নের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল? নয়নের প্রতি তখনও তার আবেগ কাজ করছিল বলে? নিজেকে ও স্বামী রিফাতকে সন্ত্রাসী নয়নের সম্ভাব্য অনিষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে? নাকি নয়নের হাতে তার সাথে মিন্নির আগেকার মেলামেশার এমন কিছু অডিওভিজুয়াল ডকুমেন্ট ছিল, যা প্রকাশ হয়ে পড়লে মিন্নি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছিল?

এসব প্রশ্নের বিচারে কিশোর-তরুণদের প্রতি আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বড় হয়ে আসে। এ সমাজ মিন্নি ও নয়নদের বিচার করতে পারে। তাদের নষ্টতা ও ভ্রষ্টতার জন্য ছি ছি করতে পারে। কিন্তু মিন্নি ও নয়নরা যে এ সমাজেরই বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি তা কি স্বীকার করতে পারে? এ ব্যাপারে কোন রূপ দায়িত্ব নিতে পারে? স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা যখন প্রেমের নামে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মেলা-মেশায় লিপ্ত হয়, এ সমাজ কি কেবল ছি ছি ও সরেস নারী কেলেঙ্কারি চর্চা করা ছাড়া বেপথু ছেলে মেয়েদের রক্ষার জন্য আদৌ কোন ব্যবস্থা নিতে পারে? স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীদেরকে যখন বখাটে ও ষন্ডা-মার্কা কিছু ছাত্র প্রেম প্রস্তাবের নামে উত্যক্ত করে বেড়ায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্বেচ্ছায়/অনিচ্ছায় তথাকথিত প্রেমের নামে অসামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে, এ সমাজ ঐ অসহায় মেয়েগুলোকে কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম? ক’দিন পর পর এখানে-সেখানে যে পরিত্যক্ত নবজাতক পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো কি আকাশ থেকে আসে?

এসব 'কি' বা 'কেন'-এর উত্তর যতদিন না পাচ্ছেন, আপনি ধরে নিতে পারেন, একের পর এক রিফাত-মিন্নি-নয়নের মতো আরও ট্রাজেডির জন্ম এ সমাজে ঘটে চলবে।

আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status