মত-মতান্তর

কওমিপাড়া, গণতন্ত্র এবং...

সাজেদুল হক

৪ অক্টোবর ২০২০, রবিবার, ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন

শনিবার একই দিনে দু’টি অন্যরকম ভোট হয়ে গেল ঢাকায়। এমনিতে গত ক’ বছরে ভোট নিয়ে আমজনতার আগ্রহ তলানিতে ঠেকেছে। ‘বিরানি’ দিয়েও ভোটমুখী করা যায় না তাদেরকে। তবে গতকালের নির্বাচন নিয়ে তাদের বেশ আগ্রহ ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, নানা উপায়ে তারা তাদের মতামতের জানান দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কোনটিতেই তাদের ভোটাধিকার ছিলো না। কারণ দু’টি নির্বাচনেই নির্বাচিত অল্প সংখ্যক ব্যক্তির ভোটাধিকার ছিল।

এ খবর নিশ্চয় পাঠকদের এতোক্ষণে জানা হয়ে গেছে, টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকা বাফুফে বস হিসেবে বরাবরই সমালোচিত। তাতে কি? ভোটেইতো তিনি জয়লাভ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীরাও যে ফল মেনে নিয়েছেন।

একই দিনে অভিনব এক নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি ছিল পর্যবেক্ষকদের। কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্ববৃহৎ বোর্ড মাদারিসিলি আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)। এই বোর্ডের অধীনে সারা দেশে রয়েছে ১৩ হাজার মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই বোর্ডের গুরুত্ব বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য নানা কারণে কওমিপাড়ায় এই বোর্ড নিয়ে তুমুল আলোচনা ছিল। কয়েকজন কর্তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছিল অনিয়মের। সদ্য বিদায়ী মহাসচিবের বিরুদ্ধেও সে অভিযোগ ছিল। সে যাই হোক, গত মাসে এক নজিরবিহীন ‘অভ্যুত্থানে’ হেফাজত হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী মাদ্রাসায় পরিবর্তন আসে। আল্লামা আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। পদত্যাগ করেন মাদ্রাসা প্রধান আল্লামা শফীও। এর একদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কওমি মাদ্রাসাগুলো বরাবরই ছিল রাজনীতির বাইরে। সরকার ও রাজনীতি নিয়ে তাদের কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালের পর দৃশ্যপটের পরিবর্তন আসে। শাপলার ঘটনাপ্রবাহ হেফাজতের সঙ্গে সঙ্গে কওমিপাড়াকেও নিয়ে আসে লাইমলাইটে। ভিনদেশি অনেক বড় বড় অতিথিও পা ফেলেন হাটহাজারীতে। যদিও ধীরে ধীরে হেফাজতের ভূমিকার পরিবর্তন হতে থাকে। দেশি-বিদেশি নানা মহল এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সরকারের সঙ্গে হেফাজতের প্রভাবশালী অংশটির যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বলা হয়ে থাকে, আল্লামা আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

হাটহাজারীর নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার পর আনাস মাদানী-মুফতি ফয়জুল্লাহর প্রভাবাধীন অংশটির মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। তারা বেফাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ তৎপরতা দেখায়। এক্ষেত্রে যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এ নিয়ে পর্দার আড়ালে নানা ঘটনা ঘটে। চরমোনাইপীরের সমর্থকরাও যোগ দেন এই পক্ষে। মহাসচিব পদে তাদের সমর্থন ছিল মাওলানা মুসলেহ উদ্দিনের প্রতি। নানা নাটকীয়তার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে জয়ী হন মাওলানা মাহমুদুল হাসান। তিনি ৬৩ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী পান ৫০ ভোট। তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর আমীর। এছাড়া, সরকার বিরোধী জোটের রাজনীতিতে সক্রিয়। অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নির্বাচিত হন মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি ৭৩ ভোট পান। মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন পান ৩৯ ভোট। তাৎপর্যপূর্ণ এই নির্বাচনে বেশ কিছু বিষয় সামনে এসেছে-

১. নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ প্রার্থী ছিলেন না। তবে ভোটের আগের কয়েক দিনের কার্যক্রমে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে  মাওলানা মাহমুদুল হাসান এবং মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীর মধ্যে কেউ একজন সভাপতি নির্বাচিত হবেন। তাদের পক্ষে প্রচারণা চালায় দুই ভাবধারার দু’টি অংশ।

২. লিখিত মাধ্যমেই ভোটাররা তাদের মতামত দিয়েছেন। ভোটের আগে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ পাওয়া গেলেও ভোটের দিন কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোট কারচুপির কোন অভিযোগও ওঠেনি। সব পক্ষই এ ফল মেনে নিয়েছে।

৩. দিনের শেষে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য দেখা গেছে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদে হেরে গেলেও মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনীত হয়েছেন। তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং বেফাকের নতুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুল হাসান।

৪. সাম্প্রতিক কার্যক্রম কওমি অঙ্গনে বিভক্তি ও মতভেদের বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেছে। হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতা নির্বাচন যে অত্যন্ত কঠিন হবে তা আরো খোলাসা হয়ে গেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status