মত-মতান্তর

‘ওই দেখা যায় ধর্ষকের বাড়ি’

শামীমুল হক

২ অক্টোবর ২০২০, শুক্রবার, ১১:০২ পূর্বাহ্ন

আচ্ছা গণধর্ষণের নায়কেরা কি করে দম্ভোক্তি করে? ওদের ঘরেও তো মা-বোন আছে। ওদের বোন যদি এমনভাবে ধর্ষিত হয় তখন কি করবে? এটা কি ভেবেছে ওরা? ধর্ষকদের মা-বাবা কি এমন পুত্রকে নিয়ে গর্বিত? যদি তা না হয়, তাহলে তাদেরও তো দায় রয়েছে। তার সন্তান কোথায় কি করছে? খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্ব তো তাদের। সন্তানের মধ্যে কাম-বাসনার উদয় হয়েছে সত্যিকারের অভিভাবক হলে সেটা তো বোঝার কথা। এমনটা দেখলে তাকে বিয়ে দিতে পারতো। আর এটা করলে তার সন্তানকে ধর্ষকের তকমা নিয়ে বাঁচতে হতো না। পিতা-মাতাকেও সমাজে মাথা নিচু করে চলতে হতো না। কেউ তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারতো না, ওই যায় ধর্ষকের মা! ওই যায় ধর্ষকের বাবা!
আচ্ছা, ধর্ষকদের বাড়ি চিহ্নিত করে ওইসব বাড়িতে প্রশাসনিকভাবে ‘এটি ধর্ষকের বাড়ি’ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? আর এ সাইনবোর্ড দেখে মানুষ ওই বাড়ির দিকে থু থু নিক্ষেপ করবে। সামাজিকভাবে হেয় হবে ধর্ষকের পরিবার। কেউ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। দূর থেকে মানুষ সাইনবোর্ড দেখে বলবে ওই যে ধর্ষকের বাড়ি। এতে করে সমাজের অন্যরাও সতর্ক হবে। সমাজ থেকে ধর্ষকের সংখ্যা কমে যাবে। কারো মনে ধর্ষণের চিন্তা জাগলেও ‘ধর্ষকের বাড়ি’ সাইনবোর্ডের কথা মনে পড়লে সে এ পথ থেকে ফিরে আসবে। মূল কথা- এটি ধর্ষকের বাড়ি এই সাইনবোর্ড তাকে ধর্ষণের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
নদীতে জোয়ার ভাটা হয়। জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় আশেপাশের বাড়িঘর। কিছু সময় পর আবার শুরু হয় ভাটার টান। তখন সব পানি সরে যায়। জোয়ার ভাটার নদী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। সকালে জোয়ার এলে বিকালে ভাটা। জোয়ার ভাটার এ নিয়মের সঙ্গে যেমন মিশে গেছে কর্ণফুলী। তেমনি মিশে গেছে আশেপাশের মানুষ। জোয়ার ভাটা জেনেই তারা বসবাস করে। জোয়ারের পানি নদীর তীর ছাপিয়ে আশেপাশের বাড়িঘরে প্রবেশ করবেÑ এটাই নিয়ম। কিন্তু বর্তমানে দেশে ধর্ষণের যে জোয়ার বইছে তা কি কর্ণফুলীর মতো সমাজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে? কর্ণফুলীতে ভাটা থাকলেও ধর্ষণে তো ভাটা নেই। এটা যে করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বৃহস্পতিবার ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। চলতি বছর নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৫ জন। আর গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০৮টি। এ তথ্য শুধুমাত্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নেয়া। এমন বহু ঘটনা আছে যা পত্রপত্রিকায় আসে না। লোক লজ্জার ভয়ে অনেকে প্রকাশ করে না। এমন সংখ্যা কত কে জানে?
সম্প্রতি সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ দেশে-বিদেশে আলোড়ন তুলেছে। ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মী এ ধর্ষণে জড়িত। শুধু তাই নয়, এরা পুরো ছাত্রাবাসকেই কলুষিত করে রেখেছে বহু আগে থেকেই। নিয়মিত সেখানে ধর্ষণ হতো। কত নারী যে সম্ভ্রম হারিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এমসি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ফিরে গেছে-এর ইয়ত্তা নেই। আশেপাশের বাসিন্দারা বলেছেন, ওরা ছাত্রাবাসসহ এমসি কলেজ ক্যাম্পাসকে ধর্ষকপুরী বানিয়ে ছেড়েছে। গ্রেপ্তার হয়েও ওদের দম্ভোক্তি সবাইকে হতবাক করেছে। ওরা দলবেঁধে ধর্ষণ করতো। করতো উল্লাস। কলেজের শিক্ষক বাংলোও ছিল ওদের দখলে। সেখানেও চলতো রাসলীলা। কলেজ কর্তৃপক্ষ সবই জানতেন। কিন্তু নীরব ছিলেন। তারা দেখেও না দেখার ভান করতেন। আর এভাবেই ওদের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। সিলেট এমসি কলেজের ঘটনার পাশাপাশি খাগড়াছড়িতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানেও ছয়জন ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখানে ধর্ষকরা নিরাপদ বাসস্থান নিজ বাড়িতে হানা দেয়। দরজা ভেঙে ৯ ধর্ষক ধর্ষণ করে এক নারীকে। এ সময় ধর্ষকদের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে মা এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করা হয়। ধর্ষণ শেষে লুটপাট চালায় ধর্ষকরা। সম্প্রতি চট্টগ্রামেরই আরেক ঘটনা আলোচনায় আসে। বান্ধবীর সহযোগিতায় তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। এখানেও এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডবলমুরিং থানাধীন সুপারিওয়ালাপাড়ায় বর্বর এ ঘটনা ঘটে।  ছাত্রলীগ নেতা চান্দু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন নূরী আক্তার ও তার স্বামী। এই নূরীই তার বান্ধবীকে চান্দু মিয়ার হাতে তুলে দেয়। ধর্ষিতা ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে এ ঘটনার শিকার হয়। তার ফুফাতো বোনের বান্ধবী নূরী আক্তার। সেই সুবাদে নূরীর সঙ্গেও ওই তরুণীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়। নূরী ওই তরুণীকে তার বাসায় বেড়াতে নিয়ে যায়। রাতে নূরী  কৌশলে ওই তরুণীকে চান্দুর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই ধর্ষিত হয় ওই তরুণী। মানুষ কত হিংস্র হয়ে উঠেছে এসবই তার প্রমাণ।
এমসি কলেজে গণধর্ষণের পর ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, ওরা ছাত্রলীগের কেউ নন। কারণ সিলেটে ছাত্রলীগের কমিটিই নেই। এমনটা বলা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উস্কে দেয়ার শামিল। কমিটি নেই বলে সিলেটে ছাত্রলীগ নেই কে বলেছে? তিনি দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন বক্তব্য দেয়ায় দেশবাসী অবাক হয়েছেন। এমন বক্তব্য ধর্ষণের জোয়ারকে আরো বেগবানই করবে। ভাটার টান কখনই দেখা যাবে না। ধর্ষণে জোয়ার নয়, ভাটার টান আনতে হবে। এ জন্য সমাজ, প্রশাসন, রাষ্ট্র সবারই একযোগে কাজ করতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status