প্রথম পাতা

শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে চাননি আবিদ

মোহাম্মদ ওমর ফারুক

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নির্বাচিত ভিপি। এরশাদ সরকারের আমলে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে খেটেছেন জেলও। পড়াশোনায় ছিলেন তুখোড়, ছিলেন হার্ভার্ডসহ নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখন পড়াচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে। কোনো দিক দিয়ে খ্যাতির কমতি নেই তার। এভাবেই অনায়াসে একটি জীবন কাটিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু না, শুধু নিজের জন্য ভাবতে চান না তিনি। কাজ করতে চান পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য। তিনি হচ্ছেন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সন্তান ডা. রুহুল আবিদ। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিষ্ঠা করেছেন হেল্‌থ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (হায়েফা) নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক, রিকশা চালককে, রোহিঙ্গাদের তিনি চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি ২০২০ সালে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত হন তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান। এর পর থেকেই নতুন করে আলোচনায় আসে তার এই কার্যক্রম।

মানবজমিন এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ডা. রুহুল আবিদ জানিয়েছেন তার পথ চলার বিস্তারিত। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ঘটনা। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর তাদের প্রতি আমার মায়া তৈরি হয়। তাই বিদেশে বসে থাকতে পারিনি। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই আমি ও আমার পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি সকল সুবিধাবঞ্চিতদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চাই। তাদের নিয়ে কাজ করতে আমার অসম্ভব ভালো লাগে।

হায়ফা প্রতিষ্ঠা হয় যেভাবে: ডা. আবিদের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মেয়ে বন্ধু রোজমেরি বি দুদা দুই মাস পর পর আফ্রিকা যেতেন। সেখানে গিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের চিকিৎসায় কাজ করতেন। তখন তিনি ভাবলেন, আমি কেন আমার দেশের মানুষ নিয়ে কাজ করতে পারি না। আমার দেশের বড় একটা অংশ চিকিৎসা সেবার বাইরে আছে। সেই চিন্তা থেকে ২০১২ সালে ওই বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন অলাভজনক সংস্থা হেল্‌থ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (হায়েফা)। এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পেছনে সেই বন্ধুর উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ডা. আবিদ বলেন, হায়েফা প্রতিষ্ঠা হওয়ার এক বছর পর রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। এর তিন মাস পরেই আমার সেই হার্ভার্ডের বন্ধু, আমার মেয়ে ব্রেইন ক্যান্সার স্পেশালিস্ট তানায আবিদ, এমআইটি’র ছাত্রী নাজিয়া চৌধুরী ও হামজা জামান নামের একজন শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ সালের জুলাইয়ের দিকে দেশে আসি। তখন থেকেই মূলত আবিদ তার কাজটি শুরু করেন। এরপর থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের বেশিরভাগই স্বেচ্ছাসেবী ছিল। এখন আমরা তাদের বেতন দিচ্ছি। তবে আমরা যারা উপরে আছি, সবাই স্বেচ্ছাসেবী। এসব কাজের জন্য আমরা কোনো বেতন নেই না। আমার এক বন্ধুতো তার একটি দোতলা বাড়িও আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। আমরা মূলত পোশাকশ্রমিক ও রিকশাচালক এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছি। গত সাত বছরে প্রায় প্রতিষ্ঠানটি ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক এবং ১ হাজার ২০০ রিকশাচালককে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৯ হাজার সুবিধাবঞ্চিত নারীর জরায়ু ক্যানসার স্ক্রিনিং ও চিকিৎসাসেবা এবং কক্সবাজারে শরণার্থীদের দুই ক্যাম্পে দেড় লাখ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়কে বিনামূল্যে সব ধরনের চিকিৎসা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রশ্ন ছিল এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে কেন এমন একটি অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে তিনি আগ্রহী হলেন। এমন প্রশ্নে ডা. রুহুল আবিদ জানান, এমবিবিএস শেষে ১৯৮৮ সালে তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে হবিগঞ্জের ডানকান কোম্পানির চা-বাগানে যোগ দেন। সেখানে ১০ মাসের পর তিনি চিফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে কুলাউড়ার লংলা চা-বাগানের সেন্ট্রাল হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানে গিয়ে তিনি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কাছ থেকে দেখেন। তিনি বলেন, ওই সময়ে চা-শ্রমিকের অনেকেই ভয়ে তাদের বাচ্চাদের টিকা দিতেন না। ফলে সামান্য অসুখে মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। তখন তিনি ভাবলেন, তাদের জন্য কি করা যায়, কীভাবে তাদেরকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায়। সেইভাবে তিনি পরিকল্পনা করলেন। এর ধারাবাহিকতায় কয়েকজন চা-শ্রমিককে বাছাই করে গর্ভকালীন জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও টিকার গুরুত্ব নিয়ে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা অন্য শ্রমিকদের বাসায় গিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন। দারুণ ফল এসেছিল এমন উদ্যোগে। তিন বছরের চেষ্টায় ১০টি চা-বাগানের শ্রমিক ৯৭ শতাংশ বাচ্চার টিকা দিতে সক্ষম হলেন আবিদ। এর আগে চা-বাগানের টিকার হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। তিনি জানান, তখন থেকেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য তার দরদ ও ভালোবাসা তৈরি হয়। সেই থেকেই তিনি এমন মানুষের জন্য সুযোগ পেলে কাজ করতেন।

যে কারণে আলোচনায়: সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিতে রুহুল আবিদ ও তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হায়েফা উদ্ভাবন করেছে আধুনিক প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড ‘নীরোগ’। এটি এক ধরনের অ্যাপস। এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীর পরিচয়ের পাশাপাশি তার শরীরের রোগের ইতিহাস ভবিষ্যতের জন্য সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। পাশাপাশি নির্ভুল চিকিৎসাসেবা দিতে সহায়তা করে নীরোগ। এটি বিদ্যুৎ ছাড়া সৌরশক্তি দিয়েও চালানো যায়। এতে ইন্টারনেটও প্রয়োজন পড়ে না। ডা. আবিদ বলেন, এই ডাটার উপর নির্ভর এখানে সিগন্যাল দেয় অ্যাপসটি। তখন সহজেই রোগীর অবস্থান নির্র্ণয় করা যায়। তিনি জানান, ই-ট্রান্সপারেন্সির মাধ্যমে খুব সহজেই রোগীর ফলোআপ পাওয়া যায়। তার রোগ ট্র্যাক করা যায়। নতুন রোগ শনাক্ত করে ভালো চিকিৎসা সেবা দেয়া যায়। আমরা এরইমধ্যে ইলেকট্রনিক হেল্‌থ রেকর্ডের মাধ্যমে রংপুরের উলিপুর, নাগেশ্বরী, চিলমারী, ভোলার বাসিন্দাসহ, দেশের কয়েকটি গার্মেন্টস কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছি। এই পদ্ধতি বিস্তৃত করা গেলে খুব সহজেই দেশের মানুষ যে কোনো জায়গায় গিয়ে ভালো চিকিৎসা পেতে পারেন। করোনাকালে অনলাইনে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন জানিয়ে এ থেকে (করোনাভাইরাস) দেশের ও পৃথিবীর মানুষের আরো অনেক কিছু শেখার আছে এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার দরকার। আবিদ এই কাজের জন্য ২০১৮ সালে গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জস কানাডার ‘স্টারস ইন গ্লোবাল হেল্‌থ’ পুরস্কার পেয়েছেন। ওই পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তার প্রতিষ্ঠান আরো দশহাজার রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন। হায়েফার এমন উদ্যোগ দেখে, চ্যালেঞ্জস কানাডা তাদেরকে আরো অর্থ দেন কাজ করার জন্য।

আবিদের চিকিৎসক হওয়ার গল্প: ডা. রুহুল আবিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, অন্যকিছু না হয়ে কেন তিনি চিকিৎসক হতে গেলেন, এমন প্রশ্নে আবিদ জানান, তখন তিনি ক্লাস সেভেনে পড়তেন। তখন তার দাদী অ্যাজমা রোগী ছিলেন। সেই সময় অ্যাজমা খুব ভয়াবহ রোগ ছিল। তখন দাদীর জন্য রাত বিরাতে ডাক্তারের জন্য যাওয়া লাগতো। অনেক সময় ডাক্তার বাড়িতে থাকতেন, আবার বাইরে থাকতেন। ডাক্তার নিয়ে মাঝেমধ্যে খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। তখন তিনি ভাবতেন একজন ডাক্তার ঘরে থাকলে কেমন হয়। সেই থেকে স্বপ্ন দেখেন তিনি ডাক্তার হবেন। বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ। সেই হিসেবে ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন, পড়াশুনা করেছেন। ডা. রুহুল আবিদ পড়াশোনা করেছেন ধানমন্ডি বয়েজ স্কুল, ঢাকা কলেজ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৩৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতি করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের (ঢামেকসু) ভিপি (১৯৮৪-৮৬) ছিলেন। এমবিবিএস শেষ করেছেন ১৯৮৮তে। মাঝখানে কয়েকবছর চাকরি করে ১৯৯৩ সালের শুরুতে মলিকুলার বায়োলজি ও বায়োকেমিস্ট্রির ওপর পিএইচডি করতে জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। চার বছর পর পিএইচডি শেষ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যান। ২০০৬ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এর পর ২০১১ সালে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে সহযোগী অধ্যাপক পদে চাকরি নেন আবিদ। ব্যক্তিজীবনে এক ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক তিনি। ছেলে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, মেয়ে ব্রেইন ক্যান্সার বিশেজ্ঞ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status