শেষের পাতা

হাটহাজারী মাদ্রাসা

রুদ্ধশ্বাস ৩৬ ঘণ্টা

মো. আবু শাহেদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) থেকে

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ৮:৫০ পূর্বাহ্ন

বুধবার। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দেড়টা। জোহরের নামাজের পর হঠাৎ করেই চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা ময়দানে ছাত্ররা জড়ো হন। এক এক করে কয়েক হাজার ছাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই জমা হয়ে মাদ্রাসার শাহী গেট ও অন্যান্য প্রবেশপথ বন্ধ করে তালাবদ্ধ করে দেন। মাদ্রাসার চারপাশে শিক্ষার্থীরা মাথার পাগড়ি দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে হাতে লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা মসজিদের মাইক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক মাওলানা আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন, 
আমাদের এই আন্দোলন একান্তই মাদ্রাসা বিষয়ক তাই প্রশাসন ও এলাকাবাসী যেন মাদ্রাসায় হস্তক্ষেপ কিংবা ঝামেলা না করে। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা পাঁচটি দাবি পূরণের জন্য মাইকে ঘোষণা করেন, দাবিগুলো হচ্ছে- আল্লামা শফীর পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীকে অনতিবিলম্বে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করতে হবে। সাধারণ ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করে সব ধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আল্লামা আহমদ শফী মাজুর বা অক্ষম হওয়ায় হুজুরকে পরিচালকের পদ থেকে সম্মানজনক অব্যাহতি দিয়ে ছের পুরস্ত বা উপদেষ্টা বানাতে হবে। ওস্তাদদের পূর্ণ অধিকার ও বিনিয়োগ-নিয়োগকে শূরার নিকট পূর্ণ ন্যস্ত করতে হবে। বিগত শূরার হাক্কানী আলেমদেরকে পুনর্বহাল ও বিতর্কিত সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে।

তারা মসজিদের মাইকে আরো বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রশাসনের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা যাবে না। যদি পুলিশ প্রশাসন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের জন্য মাদ্রাসার ভিতরে প্রবেশ করে তাহলে আমাদের সাধারণ ছাত্রদের লাশের উপর দিয়ে যেতে হবে। এই বলে বারবার আনাস মাদানী রুমের দিকে এগিয়ে যায় এবং বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন চলাকালে মাদ্রাসার ভেতরে আনাস মাদানিসহ তিনজন শিক্ষকের কক্ষ ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দিন রুহিকেও।

শিক্ষার্থীরা হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফী, মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক আল্লামা শেখ আহমদ, মাওলানা আনাস মাদানী, সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা আহাম্মদ দিদার কাসেমীসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে মাদ্রাসায় অবরুদ্ধ করে রাখে বিক্ষোভকারীরা।

ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে বুধবার রাত সাড়ে দশটার দিকে মাদ্রাসার শূরা মজলিসের তিন সদস্যের বৈঠকে মাওলানা আনাস মাদানীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। এবং ছাত্রদেরকে হয়রানির শিকার না করারসহ এ দু’টি দাবি শূরা বৈঠকে মেনে নেয়া হয়। আর বাকি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে আগামী শনিবার শূরা বৈঠকে বসার কথা জানানো হয়। ফলে রাত ১১টার পর বিক্ষোভ থামায় ছাত্ররা।

এ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর কার্যালয়ে মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকের উড়ো খবর পেয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাঠে পুনরায় অবস্থান নেয়। তারা বারবার মসজিদের মাইকে মাইকিং করে সাধারণ ছাত্রদেরকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। আন্দোলনকারীরা বলেন, আমাদের দাবি পূরণ না করে মাদ্রাসা আগামী তিন মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমরা আমাদের দাবি পূরণের জন্য এই আন্দোলন অব্যাহত রাখবো।

আন্দোলনকারীদের বাকি দাবিগুলো পূরণের জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে হেফাজত ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর কার্যালয়, সহযোগী পরিচালক আল্লামা শেখ আহমদের কার্যালয়, আল্লামা ওমর ও মাদ্রাসার শিক্ষাভবন ভাঙচুর চালায়। এ সময় হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফী নিজ কার্যালয়ে ছিলেন।

খবর পেয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র‍্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও মাদ্রাসার সব গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। দাবি আদায় না হলে মাদ্রাসার সমস্ত একাডেকিম কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলেও মাইকে ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারী ছাত্ররা।

মজলিসের শূরা কমিটির বৈঠক বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত মাদ্রাসার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- আল্লামা সালাউদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা নোমান ফয়েজি, মাওলানা সোহায়েদ নোমানী, মহিবুল্লা বাবুনগরী, মুফতি নুর আহম্মদ, মাওলানা দিদার, মাওলানা কবির আহম্মদ ও মাওলানা ফোরহান। শূরা কমিটির সদস্য মাওলানা সালাউদ্দীন নানুপুরী বৈঠকের সিদ্ধান্ত মাইকে পাঠ করে শোনান। মজলিসে শূরার বৈঠকে হেফাজত ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। মজলিসে শূরা অব্যাহতি গ্রহণ করে আল্লামা শফীকে সদরুল মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছে। আল্লামা আহমদ শফী শারীরিক গুরুতর অসুস্থ বিধায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়।

বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় আল্লামা শাফীকে চিকিৎসারজন্য হাটহাজারী ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে মাদ্রাসা থেকে বের করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্সটিকে রাস্তায় দীর্ঘ ৪০ মিনিট আটকে রাখে। রাত পৌনে ১টার দিকে আল্লামা শফী মাদ্রাসা ত্যাগ করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। অভিযানের শঙ্কায় শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়ায়। ওদিকে আল্লামা শফীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হসপিটালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়।

তৃতীয় দিন পবিত্র জুমার নামাজ উপলক্ষে হাটহাজারী মাদ্রাসার শাহী গেটের পকেট গেট আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কড়াকড়ি নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে খুলে দেয়। মাদ্রাসা কেন্দ্রীয় মসজিদে জুমার নামাজের পূর্বে বয়ান করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এ সময় তিনি মাদ্রাসা খোলা রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তোমরা ছাত্ররা ঠিকমতো পড়াশোনা করবে। তোমরা পড়ালেখায় মনোযোগী হও এবং আগামীকাল থেকে মাদ্রাসা খোলা থাকবে ও ক্লাস যথারীতি চলবে। তোমরা ক্লাসে অংশগ্রহণ করবে। তিনি আরো বলেন, আল্লামা আহমদ শফী চিকিৎসাধীন আছেন। আপনারা সবাই হুজুরের জন্য দোয়া করবেন। জুমার নামাজের পর মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলে মাদ্রাসার শাহী গেটের পকেট গেট পুনরায় তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status