প্রথম পাতা

স্বাস্থ্যবিধি ভুলতে বসেছে মানুষ

আলতাফ হোসাইন

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

করোনার গতি কমেছে এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই কারও হাতে। তারপরও জীবন জীবিকার তাগিদে সচল হচ্ছে সবকিছু। সরকারি বিধি-নিষেধ একে একে উঠে গেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার স্বার্থে। বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ব্যবস্থাও নেয়া হবে। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে মানুষের করোনাভীতিও। বাইরে বের হলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও এখন দেখা যাচ্ছে অর্ধেক মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করছেন। গণপরিবহনে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও সেখানে চালক এবং সহকারীকেও দেখা যাচ্ছে মাস্ক ছাড়া। হাটে, বাজারে, উন্মুক্ত স্থানে মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলাচল করছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণের শুরুতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে মানুষকে যতোটা সচেতন দেখা গেছে তা এখন আর দৃশ্যমান নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনা সংক্রমণের মধ্যেও মানুষ যেন স্বাস্থ্যবিধি ভুলতে বসেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে করোনার চিত্র এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। তুলনামূলক মৃতের সংখ্যা কমে এলেও কোনোদিন বাড়ছে, কোনোদিন কমছে। প্রতিদিনের আপডেটে আক্রান্তের সংখ্যাও কম দেখা গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু পরীক্ষা কম হচ্ছে তাই আক্রান্তের সংখ্যাও কম দেখা যাচ্ছে। সে হিসাবে মূলত আক্রান্ত আরো বেড়েছে বলেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ।

সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষই বাড়তি কোনো সতর্কতা মানছেন না। বাইরে বের হলে মাস্ক পরছেন না। মাস্ক সঙ্গে থাকলেও সেটি একেবারেই গুরুত্ব দিয়ে পরছেন না। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে খাবার হোটেল, কাঁচাবাজার, সেলুন, রিকশা চালক, গণপরিবহনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। এদের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষের মাঝে করোনা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। তাদের কেউ কেউ বলছেন, করোনা দুর্বল হয়ে গেছে, কেউ বলছেন করোনা এমনিতেই চলে যাবে, কেউবা বলছেন করোনা নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই, বাঁচা-মরা আল্লাহ্‌র হাতে।

চল্লিশোর্ধ্ব রফিকুল ইসলাম থাকেন রাজধানীর শান্তিবাগের একটি ব্যাচেলর বাসায়। কিছুদিন আগে তার জ্বর-কাশি শুরু হয়। করোনার উপসর্গ থাকলেও তিনি পরীক্ষা না করিয়ে বরং ওই অবস্থাতেই বাইরে গেছেন এবং স্বাভাবিক চলাফেরা করেছেন। তার এক রুমমেট জানান, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি কখনোই মাস্ক পরেননি। এ নিয়ে অন্যান্য রুমমেটদের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডাও হয়। এরপরও তিনি বিশ্বাস করেন না যে মাস্ক পরলে সুরক্ষা থাকা যায়।

ওদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। কয়েকটি গণপরিবহনে উঠে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতো দূরের কথা, ড্রাইভার-হেল্পার কারোর মুখেই মাস্ক নেই। যাত্রীদের কারো কারো মুখে মাস্ক থাকলেও কিছু বাসে গাদাগাদি করে লোক উঠাতে দেখা গেছে। বাসগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার প্রথম কয়েকদিন দেখা গেলেও এখন তা একেবারেই অনুপস্থিত। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বাসে উঠার সময় স্যানিটাইজার দেয়া হয় না। অনেক সময় গাদাগাদি করে লোক উঠানো হয়। বাসের একজন হেল্পার জানান, কিছুদিন আগে বাসে প্যাসেঞ্জার পাওয়া যেতো না। এখন তুলনামূলক লোক বাড়ছে। আগে বাসে উঠার সময় স্যানিটাইজার দিতাম এখন তেমন দেয়া হয় না। বাসে স্যানিটাইজার রাখা আছে কেউ চাইলে দেয়া হয়।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে হোটেল রেস্টুরেন্টও খুলে দেয়া হয়েছে। তবে মগবাজার, মালিবাগ ও কাওরান বাজারের কয়েকটি খাবার হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ওয়েটারের মুখে মাস্ক নেই। রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের ভিড়, সবাই খাওয়া-দাওয়া করছেন আনমনে। কোনো রেস্টুরেন্টে স্যানিটাইজার বা হ্যান্ডওয়াশের ব্যবহার দেখা যায়নি। বেসিনে দেয়া আছে ছোট একটি সাবান। সেটিই সবাই ব্যবহার করছেন। ওয়েটার এবং ম্যানেরজারদের ভাষ্যমতে- করোনার ভয় করলেতো কেউ রেস্টুরেন্টে খেতেই আসতো না। একই প্লেট, গ্লাস সবকিছু সবাই ব্যবহার করছে, যদিও সাবান দিয়ে ধুয়ে দেয়া হচ্ছে। এক সঙ্গে বসে খাচ্ছেন। কেউ কিছু মনে করছে না। রেস্টুরেন্ট খোলার পর কয়েকদিন লোকজন কম এলেও এখন আগের মতোই ভিড় হয়।

বাংলামোটর, হাতিরপুলসহ কয়েকটি এলাকার রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয়। বেলা ১১টার দিকে হাতিরপুল ঢাল থেকে পুকুর পাড় মসজিদ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লাগে। এ সময় প্রায় ৩০টি রিকশায় দেখা যায়, এদের মধ্যে অন্তত ২০ জন রিকশাওয়ালার মুখে মাস্ক নেই। তাদের ভাষ্যমতে, রিকশা চালালে শরীর এমনিতেই সারাক্ষণ ঘেমে থাকে। এরমধ্যে মাস্ক পরলে গরমে অস্বস্তি লাগে। তবে মুখে না পরলেও অনেকের কাছেই কাপড়ের মাস্ক দেখা যায়। এ বিষয়ে তারা বলছেন, একবার পরলেই মাস্ক গরমে ভিজে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। এটা আবার দ্বিতীয়বার পরতে হলে ধুয়ে শুকিয়ে পরতে হয়। করোনা নিয়ে কোনো ভয় কাজ করে কি-না এমন প্রশ্নে বেলাল নামের একজন রিকশাচালক বলেন, করোনাকে ভয় করে ঘরে বসে থাকলেতো পেটে ভাত যাবে না। আমাদের প্রতিদিন কষ্ট করে খেতে হয়। মাস্ক পরে এসি রুমে বসে থাকলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের শরীরে ঘাম মাটিতে ফেলে রিকশার প্যাডেল মাড়িয়ে আয় রোজগার করতে হয়। একদিন রিকশা না চালালে পরের দিন না খেয়ে থাকতে হবে। এ অবস্থায় করোনার চিন্তার চেয়ে ১০ টাকা কীভাবে আয় বাড়ানো যায় আমাদের সেই চিন্তাই বেশি করতে হয়।

এদিকে হাট-বাজারেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। মানুষ গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতা অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। এমন চিত্র এখন অনেক নামি সুপার শপেও দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে আগে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন এমন দোকানিরা এখন হেলা করে মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেক স্থানে হাত ধোয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এছাড়া ক্রেতারাও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে গা-ছাড়া।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন চিকিৎসক লেনিন চৌধুরী বলেন, করোনাকে এখন আর কেউ আমলে নিচ্ছেন না। যে সময়টা সতর্ক থাকা দরকার সে সময়টায় ভুলেই গেলাম যে, আমরা কোভিড সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অফিস- আদালত খুলে দিয়ে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়া হলো ঠিকই, কিন্তু নিয়ম না মেনে সেই জীবনযাপন করা যাবে না সেটা শিখিয়ে দেয়া হলো না। ফলে এখন আর কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, কেউ দূরত্ব মেনে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। দোকানে দোকানে সামাজিক দূরত্বের যে দাগ কেটে দেয়া হয়েছিল সেগুলো মিলিয়ে যাওয়ার পরে আর নতুন করে দেয়া হয়নি। ভুলে গেলে চলবে না, করোনা এভাবেই চলে যাবে না। সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status