প্রথম পাতা
করোনায় পেশা হারিয়ে নতুন পরিচয়
তামান্না মোমিন খান ও আলতাফ হোসাইন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন
এক সময় নিজের দোকান ছিল। কর্মচারী ছিল। ক্রেতাদের ভিড়ভাট্টায় সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করতেন জুয়েল। দিন শেষে কত বিক্রি হলো কত লাভ হলো তা নিয়ে চলতো হিসাবনিকাশ। কিন্তু গত ছয় মাসে পাল্টে গেছে জুয়েলের জীবন। এখন আর তার সেই দোকান নেই। নেই সেই আগের ব্যস্ততা। করোনা জুয়েলের পরিচয় বদলে দিয়েছে। জুয়েল এখন ফুটপাথের ভাসমান বিক্রেতা। একটি কার্টনের ওপর বসে তিনটি প্লাস্টিকের টুল জোড়া লাগিয়ে তার ওপর রাখা জিন্সের প্যান্ট বিক্রি করেন। জুয়েল জানান ফার্মফিউ সুপার মার্কেটের পাশেই প্যান্টের দোকান ছিল তার। দোকান খরচ কর্মচারী খরচ বাদ দিয়েও মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হতো। জুয়েল বলেন লকডাউনের দীর্ঘ সময় সবকিছু বন্ধ থাকায় দোকান ভাড়া দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মিরপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। বাসা ভাড়া দেয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে দোকান ও বাসা ছেড়ে বাড়িতে চলে যাই। বাড়িতে তিন মাস ছিলাম। সেখানেও কোনো কাজ নেই। বাড়িতে পরিবার রেখে রোজার ঈদের পরে একাই ঢাকা ফেরত এসেছি। একটি মেসে উঠেছি ভাড়া ১২০০ টাকায়। দোকানদারি ছাড়া তো আর অন্য কাজ পারি না তাই বাধ্য হয়ে ফুটপাথে প্যান্ট নিয়ে বসেছি। বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, করোনা আমার সাজানো সংসারকে তছনছ করে দিয়েছে। শুধু কি জুয়েল এমন অনেকের পরিচয় বদলে দিয়েছে মহামারি করোনা। কেউ ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় গেছেন। কেউ চাকরি হারিয়ে নিয়েছেন অন্য কাজ।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন আনোয়ার হোসেন। করোনার সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেন। এত বছর যে শ্রম, ঘাম দিয়ে আসছিলেন ব্যাংকের পেছনে সেই ব্যাংক থেকে এভাবে চাকরি চলে যাবে এটা মেনে নিতে পারছেন না তিনি। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, আর কোনো দিন ব্যাংকে চাকরি করবো না। এত বছর আমি ব্যাংকে এতটা সময় দিয়েছি যে পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারিনি। আর সেখান থেকে এই মূল্যায়ন পেলাম। আমি আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছি। বাকি জীবন আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে চাই। গণমাধ্যমকর্মী মাহমুদ সোহেল করোনার সময় চাকরি হারিয়ে এখন উদ্যোক্তা। সোহেল বলেন, করোনা আমাকে সাংবাদিক থেকে উদ্যোক্তা বানিয়ে দিয়েছে। সতের বছর গণমাধ্যমে কাজ করেছি আমি। সাংবাদিকের চাকরি হারিয়ে ঢাকা ছেড়ে আমার বাড়ি যশোরের নোয়াপাড়ায় ফিরে আসি। সেখানেই ব্যবসা শুরু করেছি। আয়িজা কালেকশন ও আম খাদক আমার নিজস্ব ব্র্যান্ড। আয়িজা কালেকশনে আমার সেবাসমূহ হচ্ছে খুলনার চুই ঝাল, সুন্দরবনের মধু, গাওয়া ঘি, খেজুরের গুড়, কালো জিরার মধু, খাঁটি সরিষার তেল, হলুদের গুঁড়া, যশোরের জামতলার মিষ্টি।
অন্যদিকে রং মিস্ত্রি রনি বলেন, আগে কোনা দিন বইসা থাকি নাই। বাসা বাড়িতে রং এর কাজ চলতোই। আমি ছিলাম হেড রং মিস্ত্রি। করোনা শুরু হওয়ার পর থেইকা গত ছয় মাসে একটাও রং করার কাজও পাই নাই। এদিকে ঘর ভাড়া দিতে পারি না। বাড়িতে টাকা পাঠাইতে পারি না। মেয়েটা প্রাইভেট পড়ে সেই টাকাও দিতে পারি না। অনেক কষ্টে এখন একটা বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি পাইছি। মাসে বেতন সাড়ে সাত হাজার টাকা। যেসব কাজ আমি কোনোদিন করি নাই এখন সেই সব কাজ করতে হয়। ছয়তলা বাড়ির পুরা সিঁড়ি ঝাড়ু দেই মুছি। ময়লা পরিষ্কার করি।
তের বছর ধরে গার্মেন্টস এ চাকরি করতেন নাসিমা। করোনাকালীন সময়ে ছাঁটাই করা হয় তাকে। অনেক জায়গায় চাকরি খুঁজেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে এখন বাসা-বাড়িতে কাজ করেন।
করোনা সংক্রমণের কয়েক মাস আগে এমদাদুল হক শিপন, তন্ময় চক্রবর্তী ও ফয়সাল উদ্যোগ নেন একটি রেস্টুরেন্ট দেয়ার। তিনজন মিলে ২৭ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে রাজধানীর কাওরান বাজারে শুরু করেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। রেস্তরাঁটি কিছুদিন ভালোই চলছিলো। তিন বন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় সব ব্যবসা-বাণিজ্য। দীর্ঘ বন্ধের পর অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও লকডাউনে পুঁজি হারিয়ে আর রেস্টুরেন্ট চালু করতে পারেনি তারা। অনেক চেষ্টা করেও উপায় না পেয়ে একেবারে রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তিনজন দিন দিকে। দু’জন চাকরি পেলেও একজন এখনো বেকার। এমদাদুল হক শিপন বলেন, গত বছরের শুরুর দিকে কাওরান বাজারে অবস্থিত ‘মেজবান’ রেস্টুরেন্টটি আমরা ভাড়া নেই। তিন বন্ধু এটি নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। আমরা শুরুই করেছিলাম মাত্র কিছুদিন হলো। এরমধ্যে যে কয়দিন রেস্টুরেন্ট চালু ছিল তাতে ব্যবসা খারাপ ছিল না। আশা করেছিলাম ধীরে ধীরে আরো ভালো হবে। অনেক কষ্টে তিনজন মিলে পুঁজি সংগ্রহ করি। ২৭ লাখ টাকার পুরোটাই আমাদের লস। চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি। লকডাউনের পর কিছুদিন চালুও রেখেছিলাম। কিন্তু বেচা-বিক্রি না হওয়ায় আবার বন্ধ করে দেই। ভেবেছিলাম পরিবেশ ভালো হলে আবার শুরু করবো, কিন্তু আর সম্ভব হয়নি। আামাদের তো আর খুব বেশি পুঁজি নেই যে লস দিয়ে ব্যবসা চালাবো। তাই বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দিয়েছি। আমি কোনোমতে একটা চাকরি খুঁজে নিয়েছি। আমার আরেক বন্ধু সেও ছোট একটা চাকরি করছে। কিন্তু আরো একজন এখনো বেকার অবস্থায় আছে।
২০১৯ সালে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেছিলেন রকি। নাম দিয়েছিলেন ‘জাহাজি’। মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করলেও অল্প দিনেই তার ব্যবসার পরিধি বাড়তে ছিল। কিন্তু করোনায় বেশকিছু দিন বন্ধ থাকার ফলে অর্থ সংকটে পড়েন রকি। কাছে যে টাকা ছিল তা দিয়ে পুনরায় আর শুরু করতে পারেননি। পরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, শুরু করেছিলাম অল্পকিছু টাকা দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে আরো ইনভেস্ট বাড়ানোর চিন্তা ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাবসহ আরো কিছু সমস্যার কারণে একেবারে বন্ধই করে দিতে হয়েছে। অনলাইন ব্যবসা করছেন এমন আরেকজন আলামিন রাবিদ। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ফিকবন। রাজধানীর বাংলা মোটরে তার অফিস। করোনার আগে বেশ ভালোই চলছিলো ব্যবসা। সৃজনশীল নানান কৌশলে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিচ্ছিলেন ফিকবনকে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। করোনা আতঙ্কে অনেকের মতো তিনিও ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এতে কয়েকমাস তার ব্যবসা একেবারে বন্ধ ছিল। তবে লস দিয়ে হলেও এখনো তিনি তার ব্যবসা চালু রেখেছেন। তার ভাষ্যমতে, যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সেখান থেকে অনেকদূর পেছনে পড়ে গেছি। তবে আমি একদম হাল ছাড়িনি। পরিস্থিতি বুঝে আবার ঢাকায় আসছি। নতুন করে শুরু করেছি। বর্তমানে লাভ তো হচ্ছে না বরং লসে আছি। কিন্তু টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লস দিয়েই ব্যবসা চালু রেখেছি।
রাজধানীর ফকিরাপুলে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা ছিল রাকিবুল হাসানের। এইচএসসি পাস করা রাকিব ২০১১ সালে নয়া পল্টনের একটি প্রেসের দোকানে কাজ নেয়। কাজ শিখে পরে নিজেই শুরু করেন ব্যবসা। জমি বিক্রি করে এবং লোন নিয়ে প্রায় ১৬ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করেন প্রেসের ব্যবসা। তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরিবার পরিজন নিয়ে এতোদিন ভালোই চলছিলো। কিন্তু করোনা যেন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তার সাজানো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান চালু করতে পারেননি। মালিবাগের একটি প্রেসের কর্মচারী মিজান বলেন, বর্তমানে কোনো অর্ডার নেই। দোকান খুলে শুধু শুধু বসে থাকা। আগে দোকানে ৩-৪ জন কর্মচারী ছিল, এখন আমি একাই আছি। তারপরও মালিক ঠিকমতো বেতন দিতে পারে না। বেতন দেবে কীভাবে? কারণ ব্যবসা পুরোটাই লসের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনো করোনার প্রভাব রয়েছে। অর্থ সংকটে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ শতাংশ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেনি। বিশেষ করে অল্প পুঁজি নিয়ে অন্তত ৬০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের পুঁজি ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন। অনেকে নিঃস্ব হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর মুদি দোকান থেকে শুরু করে সারা দেশের ছোটখাটো বিভিন্ন পণ্যের দোকান এবং বিপণি বিতানের ৫৭ লাখ ব্যবসায়ী মুখ থুবড়ে পড়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন আনোয়ার হোসেন। করোনার সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেন। এত বছর যে শ্রম, ঘাম দিয়ে আসছিলেন ব্যাংকের পেছনে সেই ব্যাংক থেকে এভাবে চাকরি চলে যাবে এটা মেনে নিতে পারছেন না তিনি। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, আর কোনো দিন ব্যাংকে চাকরি করবো না। এত বছর আমি ব্যাংকে এতটা সময় দিয়েছি যে পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারিনি। আর সেখান থেকে এই মূল্যায়ন পেলাম। আমি আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছি। বাকি জীবন আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে চাই। গণমাধ্যমকর্মী মাহমুদ সোহেল করোনার সময় চাকরি হারিয়ে এখন উদ্যোক্তা। সোহেল বলেন, করোনা আমাকে সাংবাদিক থেকে উদ্যোক্তা বানিয়ে দিয়েছে। সতের বছর গণমাধ্যমে কাজ করেছি আমি। সাংবাদিকের চাকরি হারিয়ে ঢাকা ছেড়ে আমার বাড়ি যশোরের নোয়াপাড়ায় ফিরে আসি। সেখানেই ব্যবসা শুরু করেছি। আয়িজা কালেকশন ও আম খাদক আমার নিজস্ব ব্র্যান্ড। আয়িজা কালেকশনে আমার সেবাসমূহ হচ্ছে খুলনার চুই ঝাল, সুন্দরবনের মধু, গাওয়া ঘি, খেজুরের গুড়, কালো জিরার মধু, খাঁটি সরিষার তেল, হলুদের গুঁড়া, যশোরের জামতলার মিষ্টি।
অন্যদিকে রং মিস্ত্রি রনি বলেন, আগে কোনা দিন বইসা থাকি নাই। বাসা বাড়িতে রং এর কাজ চলতোই। আমি ছিলাম হেড রং মিস্ত্রি। করোনা শুরু হওয়ার পর থেইকা গত ছয় মাসে একটাও রং করার কাজও পাই নাই। এদিকে ঘর ভাড়া দিতে পারি না। বাড়িতে টাকা পাঠাইতে পারি না। মেয়েটা প্রাইভেট পড়ে সেই টাকাও দিতে পারি না। অনেক কষ্টে এখন একটা বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি পাইছি। মাসে বেতন সাড়ে সাত হাজার টাকা। যেসব কাজ আমি কোনোদিন করি নাই এখন সেই সব কাজ করতে হয়। ছয়তলা বাড়ির পুরা সিঁড়ি ঝাড়ু দেই মুছি। ময়লা পরিষ্কার করি।
তের বছর ধরে গার্মেন্টস এ চাকরি করতেন নাসিমা। করোনাকালীন সময়ে ছাঁটাই করা হয় তাকে। অনেক জায়গায় চাকরি খুঁজেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে এখন বাসা-বাড়িতে কাজ করেন।
করোনা সংক্রমণের কয়েক মাস আগে এমদাদুল হক শিপন, তন্ময় চক্রবর্তী ও ফয়সাল উদ্যোগ নেন একটি রেস্টুরেন্ট দেয়ার। তিনজন মিলে ২৭ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে রাজধানীর কাওরান বাজারে শুরু করেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। রেস্তরাঁটি কিছুদিন ভালোই চলছিলো। তিন বন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় সব ব্যবসা-বাণিজ্য। দীর্ঘ বন্ধের পর অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও লকডাউনে পুঁজি হারিয়ে আর রেস্টুরেন্ট চালু করতে পারেনি তারা। অনেক চেষ্টা করেও উপায় না পেয়ে একেবারে রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তিনজন দিন দিকে। দু’জন চাকরি পেলেও একজন এখনো বেকার। এমদাদুল হক শিপন বলেন, গত বছরের শুরুর দিকে কাওরান বাজারে অবস্থিত ‘মেজবান’ রেস্টুরেন্টটি আমরা ভাড়া নেই। তিন বন্ধু এটি নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। আমরা শুরুই করেছিলাম মাত্র কিছুদিন হলো। এরমধ্যে যে কয়দিন রেস্টুরেন্ট চালু ছিল তাতে ব্যবসা খারাপ ছিল না। আশা করেছিলাম ধীরে ধীরে আরো ভালো হবে। অনেক কষ্টে তিনজন মিলে পুঁজি সংগ্রহ করি। ২৭ লাখ টাকার পুরোটাই আমাদের লস। চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি। লকডাউনের পর কিছুদিন চালুও রেখেছিলাম। কিন্তু বেচা-বিক্রি না হওয়ায় আবার বন্ধ করে দেই। ভেবেছিলাম পরিবেশ ভালো হলে আবার শুরু করবো, কিন্তু আর সম্ভব হয়নি। আামাদের তো আর খুব বেশি পুঁজি নেই যে লস দিয়ে ব্যবসা চালাবো। তাই বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দিয়েছি। আমি কোনোমতে একটা চাকরি খুঁজে নিয়েছি। আমার আরেক বন্ধু সেও ছোট একটা চাকরি করছে। কিন্তু আরো একজন এখনো বেকার অবস্থায় আছে।
২০১৯ সালে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেছিলেন রকি। নাম দিয়েছিলেন ‘জাহাজি’। মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করলেও অল্প দিনেই তার ব্যবসার পরিধি বাড়তে ছিল। কিন্তু করোনায় বেশকিছু দিন বন্ধ থাকার ফলে অর্থ সংকটে পড়েন রকি। কাছে যে টাকা ছিল তা দিয়ে পুনরায় আর শুরু করতে পারেননি। পরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, শুরু করেছিলাম অল্পকিছু টাকা দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে আরো ইনভেস্ট বাড়ানোর চিন্তা ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাবসহ আরো কিছু সমস্যার কারণে একেবারে বন্ধই করে দিতে হয়েছে। অনলাইন ব্যবসা করছেন এমন আরেকজন আলামিন রাবিদ। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ফিকবন। রাজধানীর বাংলা মোটরে তার অফিস। করোনার আগে বেশ ভালোই চলছিলো ব্যবসা। সৃজনশীল নানান কৌশলে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিচ্ছিলেন ফিকবনকে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। করোনা আতঙ্কে অনেকের মতো তিনিও ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এতে কয়েকমাস তার ব্যবসা একেবারে বন্ধ ছিল। তবে লস দিয়ে হলেও এখনো তিনি তার ব্যবসা চালু রেখেছেন। তার ভাষ্যমতে, যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সেখান থেকে অনেকদূর পেছনে পড়ে গেছি। তবে আমি একদম হাল ছাড়িনি। পরিস্থিতি বুঝে আবার ঢাকায় আসছি। নতুন করে শুরু করেছি। বর্তমানে লাভ তো হচ্ছে না বরং লসে আছি। কিন্তু টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লস দিয়েই ব্যবসা চালু রেখেছি।
রাজধানীর ফকিরাপুলে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা ছিল রাকিবুল হাসানের। এইচএসসি পাস করা রাকিব ২০১১ সালে নয়া পল্টনের একটি প্রেসের দোকানে কাজ নেয়। কাজ শিখে পরে নিজেই শুরু করেন ব্যবসা। জমি বিক্রি করে এবং লোন নিয়ে প্রায় ১৬ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করেন প্রেসের ব্যবসা। তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরিবার পরিজন নিয়ে এতোদিন ভালোই চলছিলো। কিন্তু করোনা যেন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তার সাজানো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান চালু করতে পারেননি। মালিবাগের একটি প্রেসের কর্মচারী মিজান বলেন, বর্তমানে কোনো অর্ডার নেই। দোকান খুলে শুধু শুধু বসে থাকা। আগে দোকানে ৩-৪ জন কর্মচারী ছিল, এখন আমি একাই আছি। তারপরও মালিক ঠিকমতো বেতন দিতে পারে না। বেতন দেবে কীভাবে? কারণ ব্যবসা পুরোটাই লসের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনো করোনার প্রভাব রয়েছে। অর্থ সংকটে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ শতাংশ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেনি। বিশেষ করে অল্প পুঁজি নিয়ে অন্তত ৬০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের পুঁজি ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন। অনেকে নিঃস্ব হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর মুদি দোকান থেকে শুরু করে সারা দেশের ছোটখাটো বিভিন্ন পণ্যের দোকান এবং বিপণি বিতানের ৫৭ লাখ ব্যবসায়ী মুখ থুবড়ে পড়েছে।