শেষের পাতা

সংঘর্ষ নয় পিটিয়ে হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে

১৫ আগস্ট ২০২০, শনিবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মী আনসার সদস্যরা পিটিয়ে ৩ কিশোর বন্দিকে হত্যা করেছে। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছে জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আর এই কারণে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মী আনসার সদস্যসহ ১০ জনকে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে ঘটনা তদন্তে সমাজসেবা অধিদপ্তর ২ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম  স্বাক্ষরিত এক  বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার ৩ বন্দি কিশোর নিহত ও চারজন আহত হওয়ার ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের  জন্য দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলো- যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার  সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নুরুল বসির ও উপ-পরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২)  এসএম মাহমুদুল্লাহ। তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে মহাপরিচালকের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার দুপুরে  যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার আহম্মেদ তারেক সামস নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট হাফিজুল হকের উপস্থিতে বৃহস্পতিবার রাতে নিহত তিন কিশোর বন্দির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। পরে পুলিশ প্রহরায় স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন। একই সঙ্গে নিহত তিন কিশোর বন্দির লাশ পুলিশ প্রহরায় নিজ নিজ এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন যশোরের জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলা শিশু ও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের নিরাপত্তা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ প্রহরায় আহত ১৪ কিশোরের চিকিৎসা চলছে যশোর জেনারেল হাসপাতালে।

যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর ‘বন্দি’ খুনের ঘটনায় নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুই গ্রুপের সংঘাত নয়, কর্মকর্তারা ঠাণ্ডা মাথায় পিটিয়ে হত্যা করেছে ৩ বন্দি কিশোরকে। আহত অবস্থায় অন্তত ১৪ কিশোর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পেলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য স্বীকার করেনি। তবে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই ঘটনাকে ‘একপক্ষীয়’বলে মন্তব্য করে গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। আর আহত চিকিৎসাধীন কিশোররা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে।

গত বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর রাতে যশোরের জেলা প্রশাসক তজিমুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হোসেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের অভ্যন্তরে যান। গভীর রাত পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজিও যান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে। দীর্ঘ প্রায় ২ ঘণ্টা তিনি উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। রাত তিনটার দিকে তিনি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হন। এ সময় তিনি মিডিয়াকর্মীদের সঙ্গে ঘটনার পূর্বাপর পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত বন্দি কিশোরদের খোঁজ-খবর নেন এবং তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। এ সময় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি কিশোররা ঘটনা সম্পর্কে মিডিয়াকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে।

বৃহস্পতিবার দিনগত রাত তিনটার দিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলে, ‘গত ৩রা আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলে। সেদিন  কেন্দ্রের প্রায় দুইশ’ জনের চুল কেটে দেওয়ায় আমার হাত ব্যথা করছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেয়া হবে জানালে সে ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকে। একপর্যায়ে কয়েক কিশোর হেড গার্ডকে মারধর করে। বিষয়টি হেড গার্ড অফিসে জানায়। সেখানে নূর ইসলাম অভিযোগ করেন, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে, তারা মাদক সেবন করেনি।’

পাভেলের ভাষ্য, ‘ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আমরা ঘটনার আদ্যোপান্ত জানানোর এক পর্যায়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ্‌, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্য স্যাররা আমাদের হাত-পা বেঁধে বেধড়ক পেটায়।’
আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর ‘বন্দি’ জাবেদ হোসেন জানায়, ‘স্যাররা ও অন্য বন্দি কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছে। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করে। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে আসে। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারপিট করে।’

যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দি ঈশান জানায়, ‘নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার (রাসেলের) জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে।’
 সে অভিযোগ করে বলে, ‘প্রবেশন অফিসার মুশফিক স্যার মারধরের সময় বলে, ‘তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে।’

আহতরা জানায়, মারধর করে তাদের এখানে- সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রাত আটটা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় বাকি আহতদের হাসপাতালে আনা হয়।

তবে উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ দাবি করেন, সমপ্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৭ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রে তাদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা চলে। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আহতদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে রাত ৮টার দিকে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তবে প্রবেশন অফিসার ও নির্যাতিতদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী।

এই প্রসঙ্গে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দিনগত গভীর রাতে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত সংবাদকর্মীদের বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে এক মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু পথযাত্রীরা কেউ মিথ্যা কথা বলে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে তারা বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হত্যার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তাদের শেষ রক্ষা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনায় মামলা হবে। সেই মামলার বাদী যে কেউ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা বা তাদের স্বজন অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষ; সর্বশেষ কাউকে না পাওয়া গেলে পুলিশ তো রয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনা একপক্ষীয় বলেও জানান অতিরিক্ত ডিআইজি। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যশোর কোতোয়ালি থানায় এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানান অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। এ সময় তিনি সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘কী কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। আমরা তদন্ত কমিটি করে দেবো। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে বৃহস্পতিবার উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে নিহতরা হচ্ছে, খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), রেজিস্ট্রেশন নম্বর- ১১৮৫৫৩, বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৭৫২৪ এবং একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার তালিপপুর পূর্বপাড়ার নানু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), রেজিস্টেশন নম্বর ১১৯০৭। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল।
এদিকে গতকাল বিকালে যশোর পুলেরহাট  কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ‘বন্দি’ তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায়  কেন্দ্রের  ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ অফিসে আনা হয়েছে।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ) তৌহিদুল ইসলাম জানান, তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ অফিসে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করা হবে। তবে এখনো কাউকে আটক দেখানো হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করার আগে তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে চাননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, দেশে ছেলেদের জন্য দু’টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। যশোর কেন্দ্রে মোট বন্দির সংখ্যা ২৮০ জন। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এই তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু  ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পরও অবস্থার যে উন্নতি হয়নি; বরং অবনতি হয়েছে বৃহস্পতিবারের ঘটনা তারই প্রমাণ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status