শেষের পাতা

ধামায় চাপা করোনা

রুমিন ফারহানা

১১ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

‘আমরা করোনা মোকাবিলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ কিংবা ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’-এর মতো বড় বড় রাজনৈতিক বুলি দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের করোনা যাত্রা কিন্তু তীব্র সংকট ছিল টেস্টিং কিট, পিপিই সহ সুরক্ষা  সরঞ্জাম, চিকিৎসা সামগ্রী এমনকি হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন, আইসিইউ’র। তারপর  ‘গোদের ওপর  বিষফোড়া’র মতো  দেখা গেল আমলানির্ভর করোনা  মোকাবিলার যুদ্ধটা শেষমেশ হয়ে দাঁড়ালো অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার বিরুদ্ধে। আরো ছোট করে বলতে  গেলে বিশ্বের ২১৬টি দেশ যখন লড়াই করে যাচ্ছে রোগের বিরুদ্ধে তখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো নকল মাস্ক, ভুয়া পিপিই, নকল করোনা সার্টিফিকেট, লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল আর ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো। ঘটনা এতদূর গড়ালো যে বাংলাদেশে নকল করোনা সার্টিফিকেট জায়গা করে নিলো সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান কিংবা আল- জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
রিজেন্ট নামক এক হাসপাতাল ঘিরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে করোনাকালীন সময়ে চলে আসা টানাপড়েন এমনভাবে উন্মোচিত হলো যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে তার পদ থেকে সরে যেতে হলো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের নেতৃত্ব  দেয়ার জন্য যে নতুন মহাপরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব নিলেন তিনি শুরুতেই নিজের এবং সরকারের জন্য আগাম দায়মুক্তি নিয়ে দুর্নীতির দায় চাপালেন আমাদের সবার ওপর। খোলাখুলি বললেন আমরা সবাই এই দুর্নীতির অংশ। এখন প্রশ্ন হলো এই ‘আমরা’টা কারা। এটি কি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, নাকি যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তিনি অথবা তার পরিবার, নাকি যারা এই দুর্নীতির বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসছেন তারা অর্থাৎ গণমাধ্যম?
দুর্নীতি দমনের লক্ষ্য নিয়ে যে পদে তিনি আসলেন সেখানে বসেই তিনি  ঘোষণা করলেন, আগে তিনি করোনা মোকাবিলা করবেন, তারপর দুর্নীতি নিয়ে ভাববেন। অথচ বাংলাদেশে করোনা দমনে মূল চ্যালেঞ্জই যে হয়ে  উঠেছে  দুর্নীতি  সেটি তার না বুঝবার কারণ নেই। গণমাধ্যমে তার এই বক্তব্য ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার পরপরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি হলো অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপর- মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলা যাবে না। নির্দেশনায় আরো বলা হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্রিফিং ও সাক্ষাৎকার প্রদান বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়ে মহাপরিচালকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়াও অংশগ্রহণকারীকে কমপক্ষে পরিচালক পদমর্যাদার হতে হবে।    
অধিদপ্তরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ  ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছিল বর্তমান মহাপরিচালক আসার আগেই। করোনার প্রথম দিকে করোনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হতো  যেখানে প্রাথমিক তথ্য দেয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। পরে এটা বাদ দিয়ে সংবাদ বুলেটিন চালু করা হয়, যাতে আর সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে মজুত টেস্ট কিটের সংখ্যার মতো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দেয়া হয় ব্রিফিং থেকে। সবদিকেই কেমন যেন লুকোচুরি, ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা।
অবাক কাণ্ড যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যমের সহায়তায় রিজেন্ট বা জেকেজি’র মতো  প্রতিষ্ঠানের করা দুর্নীতির বীভৎস চিত্র মানুষের সামনে উঠে এসেছে সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও এলো নতুন নির্দেশনা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া দেশের  কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান চালাতে পারবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে হাসপাতালগুলোর স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা হবে তা হলো, যে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বেশির ভাগ হাসপাতাল চালিয়ে আসছিল এই করোনাকালে, তারা সেগুলো আরো অবাধে এবং নিরাপদে চালিয়ে যেতে পারবে। তার ওপর আগেভাগে অনুমতি নিতে গিয়ে যে সময় হাপাতালগুলোকে দেয়া হবে তাতে  বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণগুলো বেশির ভাগ  ক্ষেত্রেই মুছে ফেলতে পারবে হাসপাতালগুলো। এর ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার যুগান্তরকে বলা কিছু কথায়-  “আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনাকালে দেখেছি বেশির ভাগ  বেসরকারি হাসপাতাল নিয়মকানুন মানে না। সেখানে নিয়মানুযায়ী চিকিৎসক-নার্স থাকে না। এমনকি চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন। এভাবে অভিযান পরিচালনা বন্ধ করে দেয়া হলে এসব অসাধু চিকিৎসা ব্যবসায়ী ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে”।
একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আমরা এই করোনা কালের শুরুতে দেখেছি  যেখানে নোটিশ জারি করে গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের নার্সদের কথা বলতে নিষেধ করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের একজন নার্স হাসপাতালের কর্মীদের খাদ্য সংকট নিয়ে একটি পোস্ট দিলে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। নার্স  নেতারা সেটি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন কর্মকর্তারা চাইলেই গণমাধ্যমে আলোচনা, বিবৃতি ও মতামত দিতে পারেন না। এমনকি করোনা পরিস্থিতি  মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) থেকে চিকিৎসকদের জন্য দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল নিম্নমানের ফেস মাস্ক। ওই সব মাস্ক গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর খেসারত হিসেবে ওই সব হাসপাতালের পরিচালকদের কাউকে বদলি আবার কাউকে ওএসডি করা হয়েছিল।  এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন মাস্ক দুর্নীতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সহ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের শক্তিশালী একটি মহল জড়িত। আর এই দুর্নীতি ঢাকতেই চিকিৎসকদের বদলি কিংবা ওএসডি  করা হয়েছে।  
এখানেই শেষ না। বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয় তখন থেকেই মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করেছে র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে আছেন কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক ও লেখক। তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। অনেকটা যেন এমন  যে যারাই সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা, ঘাটতি নিয়ে কথা বলবে তাদের খেসারত দিতে হবে ওএসডি, বদলি, গ্রেপ্তার হয়ে কিংবা মামলা খেয়ে। সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ভীত করবে তাদেরও যারা ভুক্তভোগী কিংবা মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক। এই নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন- “মানুষ তার দেশের ভালোর জন্য কথা বলবে না? তাহলে কে বলবে? দেশটা কাদের?”
জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে  টেস্টের তুলনায় করোনা শনাক্তকরণের হার ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছিলো। জুন মাসের ১৭/১৮ শতাংশ থেকে জুলাইয়ে  সেটা ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে ২২/২৩ শতাংশে পৌঁছে যায়। ঠিক তখনই সরকার করোনা টেস্ট কমিয়ে  দেয়ার চেষ্টা শুরু করে, যদিও আক্রান্তের হারের বিবেচনায় সেটা বাড়ানোর কথা ছিল। সরকার টেস্টে ফি বসায় এবং অনেক টেস্ট সেন্টার বন্ধ করে দেয়। ফলে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার টেস্ট নেমে আসে অর্ধেকে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নির্দেশিত ন্যূনতম ৩০ হাজার  টেস্টের দিকে যাওয়া দূরেই থাকুক, করোনার পিকের সময় টেস্ট সংখ্যা ১০ হাজারে নামিয়ে আনা বোধ করি  কেবল মাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব।   
করোনা নিয়ে এই সব ধামাচাপার  ছেলেখেলা আমরা এমন একটা সময় করছি যখন আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের করোনা মোকাবিলা ভীষণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। কুয়ালালামপুর ভিত্তিক কনসাল্টিং ফার্ম পেমান্ডু এসোসিয়েটস-এর তথ্যমতে  গ্লোবাল কোভিড-১৯ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১৩১তম। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি ও সংকট  মোকাবিলার সক্ষমতা এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা পরিমাপে সূচকটি  তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি দেশের যাচাইকৃত উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য একত্রীকরণের মাধ্যমে এটিকে মহামারি সংক্রান্ত তথ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ উৎস হিসেবে গড়ে তুলেছে সংস্থাটি। দুঃখজনক হলো এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে কেবল মালদ্বীপ। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ৪৯, ভুটান ৫২, শ্রীলঙ্কা ৭৫, নেপাল ৭৮ এবং ভারত ৭৯তম অবস্থানে আছে।   
উপরে আলোচিত প্রতিটি ঘটনা  দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রতিটি পদক্ষেপ আসলে নেয়া হয়েছে প্রকৃত পরিস্থিতিকে আড়াল করার উদ্দেশ্যে। একটা জরুরি পরিস্থিতিতে তথ্য আড়াল করার  চেষ্টা নাগরিকদের জন্য খুবই বিপদের কারণ। নানা রকম বাধা সত্ত্বেও করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতে বা ত্রাণ বিতরণে যতটা দুর্নীতি কিংবা অব্যবস্থাপনার খবর আমাদের সামনে এসেছে সেটাই মূলত চাপে  ফেলেছে সরকারকে। ফলশ্রুতিতে সরকারকে বাধ্য হয়েই কিছু ব্যবস্থা অন্তত নিতে হয়েছে। এখন সেই পথ বন্ধের সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হয়েছে।  
 কোনো দেশে যদি সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, কল্যাণমুখী একটা সরকার থাকে তবে সেটি করোনার মতো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবে আন্তরিকভাবে নানা পদক্ষেপ  নেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সরকারটি যদি হয় দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ, অযোগ্য তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কর্মীদের মিডিয়ায় কথা না বলতে দিয়ে  রোগটির প্রকৃত অবস্থা আড়াল করবে, হাসপাতালে অভিযানের স্বাধীনতা নষ্ট করে বেহাল স্বাস্থ্যখাতের পরিস্থিতি লুকিয়ে  ফেলবে, টেস্টের সংখ্যা অর্ধেক করে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে ফেলবে কাগজে কলমে। এমন একটি সরকার করোনার মতো এক ভয়াবহ সংকটকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে স্রেফ ধামাচাপা দিয়ে। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা এর একটা চমৎকার প্রদর্শনী দেখছি।
লেখক: সংসদ সদস্য
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status