প্রথম পাতা

ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

৮ আগস্ট ২০২০, শনিবার, ৯:০৯ পূর্বাহ্ন

ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। চীনের ভ্যাকসিনটি এদেশে ট্রায়ালের কথা থাকলেও তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশটির সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। ভ্যাকসিন নিয়ে পরামর্শক কমিটিতে কোনো আলোচনাও হয়নি বলে জানান কমিটির অন্যতম এক সদস্য। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন অতি দ্রুত ভ্যাকসিনের পেছনে ছোটা। ভ্যাকসিন তৈরির পরপরই যেন বাংলাদেশ তা হাতে পায়, সেজন্য প্রয়োজন এখন থেকেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া।

বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে আছে কি-না জানতে চাইলে- জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ট্রায়াল হচ্ছে। এতে অংশগ্রহণ করেছেন ব্রাজিলের ৫ হাজার, সাউথ আফ্রিকার ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এটা কার্যকর প্রমাণ হলে তারাই আগে পাবেন। বৃটিশ সরকারও ৫ কোটি ডোজের চাহিদা দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে কম আয়ের দেশ হিসেবে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা দেখছেন তিনি। বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মে মাসে ১০টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে। সেখানে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন, আমেরিকার মডার্নারের ভ্যাকসিন রয়েছে। চীন ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন দুটোই ভালো। চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দিয়েছিল বিএমআরসি। সেটা যদি খুব তাড়াতাড়ি শুরু হতো তাহলে বাংলাদেশ উপকৃত হতো। আমাদের এখানে ট্রায়াল হলে ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। আমাদের একটা দাবি সৃষ্টি হবে। চীনের প্রতিনিধিরাও বলে গেছেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু সচিব এখন চীনের ভ্যাকসিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল দেখবেন, তারপর আগাবেন। অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করে বলেন, দাবি করে যে ভ্যাকসিন আমরা পেতে পারি সেদিকে যাচ্ছি না। বিল গেটসের গ্যাভী ফাউন্ডেশনের ভিক্ষা করা ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমলাতান্ত্রিক গাফিলতির জন্য ভিক্ষা করার পরিণতিতে যাচ্ছি আমরা। দেশের এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, সচিব কি আমাদেরকে ভিক্ষুক বানাতে চান। জাতীয় পরামর্শক কমিটির এ সদস্য বলেন, ভ্যাকসিন বিষয়ে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, এখানে দু’টি বিষয়। একটি হচ্ছে আবিষ্কার এবং কারো সঙ্গে সহযোগী হওয়া। অন্যটি ম্যানুফেকচারিং। এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত হলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। আমরা একটির সঙ্গেও নেই। যারা ভ্যাকসিন তৈরি করলো তারা দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করবে। তিনি আরো জানান, বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য ক্রয়াদেশ বা ওয়ার্ডার দিয়ে রেখেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ওখানে বলা আছে ইক্যুইটেবল বা সবার প্রতি সুবিচার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবে। তবে ভ্যাকসিন দাতা সংস্থাগুলো কিনে দেবে। তখন বিনা পয়সায় পেতে পারে বাংলাদেশ। এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, বাংলাদেশ চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশীদার হলে সুবিধা পেতো। তখন অগ্রাধিকার থাকতো। কিন্তু এটা অনিশ্চিত দেখছি। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশ ভ্যাকসিন দৌড়ে অবশ্যই পিছিয়ে আছে।

এদিকে ৪ঠা আগস্ট সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সভাকক্ষে করোনা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চীনের তৈরি ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হবে। সচিব আরো জানান, চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের ৩য় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেছে। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি দেশের কোভিড ডেডিকেটেড সাতটি হাসপাতালের ৪ হাজার ২০০ স্বাস্থ্য কর্মীর মাঝে এই ট্রায়াল সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে। তবে সরকার এটির পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য দেশের অন্যান্য ভ্যাকসিনের ব্যাপারেও সজাগ রয়েছে। তিনি জানান, চীনা কোম্পানির করা আবেদনপত্রটি আইসিডিডিআর,বি’র মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এসেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়ার পর যদি এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, এরপর এর ফলাফল পেতে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। এরমধ্যে যদি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে যায়, তবে আমরা সেটি পাওয়ার জন্যও যোগাযোগ রাখছি। ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে উল্লেখ করে সচিব আরো বলেন, বিল গেটসের গ্যাভী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। সেপ্টেম্বরে তাদের পরবর্তী বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধির উপস্থিতি চেয়েছে। সুতরাং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর গ্যাভীর মাধ্যমেও কিছু ভ্যাকসিন দেশে আগে-ভাগেই আসবে। এর আগে ২০শে জুলাই কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পরামর্শ কমিটির এক অনলাইন সভায় সভাপতির বক্তব্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, বিশ্বে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে বাংলাদেশ তা সবার আগে এবং বিনামূল্যে পাবে। যুক্তরাজ্য, চীনসহ অনেক দেশই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বিশ্বের যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের নিচে সেসব দেশ এই ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাবে। যেহেতু বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার মার্কিন ডলারের কাছাকাছি সুতরাং বাংলাদেশ এ ভ্যাকসিন বিনামূল্যেই পেয়ে যাবে।

এদিকে, দেশে চীনের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য গত ১৯শে জুলাই অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা-আইসিডিডিআর-বি’র তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা। তবে অনুমোদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হলে এটি এক ধরনের সুবিধা নিয়ে আসবে। দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন বা স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হলে সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। বিশেষজ্ঞের মতে, এ মহামারি থেকে বাঁচতে দুটি পথ অবলম্বন করতে হয়। প্রথমত, জনগোষ্ঠীর হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা; দ্বিতীয়ত, ভ্যাকসিন তৈরি করা। যেহেতু এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার বেশি, তাই প্রতিরোধের একমাত্র রাস্তা হলো ভ্যাকসিনের ওপর ভরসা করা। তাই মহামারির শুরু থেকেই আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মহাযজ্ঞ চলছে। সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ পৃথিবীর প্রায় ১৪০টি প্রতিষ্ঠান এর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে সমর্থ হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status