শেষের পাতা

এবারের বন্যায় কেন এতো দুর্ভোগ?

পিয়াস সরকার, বালাসীঘাট, গাইবান্ধা থেকে

৬ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৬ পূর্বাহ্ন

উত্তাল ব্রহ্মপুত্র নদ। পানিতে টইটুম্বুর। নদপাড়ের মানুষগুলোর দুর্ভোগটাও অবর্ণনীয়। প্রতি বছর বন্যায় ভাসিয়ে নেয় ব্রহ্মপুত্র নদপাড়ের বালাসীঘাট এলাকা। এটির অবস্থান দারিদ্র্যপীড়িত গাইবান্ধা জেলায়। বন্যা আসবে প্রতি বছর- এটাই যেন নিয়তি খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। তবে ২০২০ সালের করোনাকালীন বন্যা যেন দুর্ভোগ সব থেকে বেশি।

এক মাস ১২ দিন যাবৎ পানিবন্দি ওই এলাকার মানুষ। পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি বন্যাদুর্গতরা। পচন ধরতে শুরু করেছে বাড়ির স্থায়ী জিনিসপত্রে। ঘাটের পাড়েই বাড়ি আমিনুর রহমানের। ফেরি করে বিক্রি করেন চুড়ি-ফিতা। তিনি হাঁটু পানিতে থাকা বাড়িতে নিয়ে যান। জানান, শুরুর দিকে পানি ছিল মাথা অবধি। ঘরের ভিতরে দেখা যায়, পচন ধরেছে খাট, আলমারিসহ সব জিনিসপত্রে। আগেই পচে গেছে কাপড়চোপড়, চাল ডাল, লেপ তোষক। একটি কাঠের চেয়ারে চাপ দিতেই ভেঙে পড়ে তা। ছোট বাড়ির ছাদ পর্যন্ত পানি থাকায় সেটাও যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার উপক্রম।

বিশ্বব্যাপী করোনার থাবা। এরই মাঝে এসেছে বন্যা। সাহায্যটাও মেলেনি অন্যবারের মতো। আকবর আলী ৫ মাস ধরে বাড়িতে বসা। পাথরের কাজ করতে গিয়ে ভেঙে যায় তার বাম হাত। গাইবান্ধা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও পুরোপুরি সেরে উঠেননি তিনি। হাতে কাপড় ও বাঁশের কঞ্চি বেঁধে বসে ছিলেন ঘরের সামনে। বলেন, ‘বন্যা আইজ এক মাসের উপরে। সাহায্য বলতে পাইছি ২ বার চাল। আর কোনো সাহায্য পাইনি।’

একই কথা বলেন, আকলিমা বেগম। এই বন্যায় বাঁধেই জন্ম নিয়েছে আকলিমার প্রথম সন্তান। জানান, এখানে থাকা অধিকাংশই পরনের কাপড় পরেই দিন যাপন করছেন। আগের বছরের বন্যায় মাঝেমধ্যেই পেতেন সহায়তা। কিন্তু এবার তা মেলেনি। শুধু চাল পেয়েছেন তিনি।

স্থানীয় দাতব্য সংস্থার একজন কর্মী আলিফ রহমান বলেন, করোনার সময় অসহায় মানুষগুলোকে নানা সহযোগিতা করা হয়। এরপর আসে বন্যা তাই চাইলেও আমরা সাহায্যের হাত বাড়াতে পারিনি।

এ এলাকার সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভাইস চেয়ারম্যান মোনোয়ারা বেগম বলেন, এখানে সাহায্য বলতে পেয়েছি দুবার চাল, ১৫ কেজি করে। তিনি বাঁধ নির্মাণের জোর দাবি জানান। বলেন, প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ছি এই বাঁধ না থাকার কারণে। এই বাঁধ নির্মাণ হলেই আমাদের দুঃখ দূর হবে। ত্রাণ চাই না, বাঁধ চাই।

এবারের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে অধিক পরিমাণে। এর আরেকটি কারণ হঠাৎ পানি চলে আসা। এক ছেলে নিয়ে সংসার বৃদ্ধ হক উদ্দিনের। একবেলা শাক-আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে পার করছেন দিন। বলেন, ‘একবেলা খাবার পাল্লে শুকরিয়া। মেলা মানুষে একবেলাও খাবার পাওচে না। জানান, ঘরের ভিতর ছিলেন। পানি বাড়ছিল নদীতে। হঠাৎ পানি চলে আসে বাড়িতে। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে বাড়িতে ৬ থেকে ৭ ফিট পানি চলে আসে। আমরা প্রয়োজনীয় কিছু সঙ্গে নিতে পারিনি। অধিকাংশ লোকেরাই নিতে পারেননি। সবার বাড়িতেই কমবেশি চাল ছিল। এই চালগুলো আনতে পারলেও অনেকের চিন্তা কমে যেত।’

পানি আসার সময় বাজার থেকে ফিরছিলেন মো. আলী। রাতে আসার সময় পানির স্রোতে বেসামাল হয়ে পড়েন। সমুদ্রের স্রোতের মতো ঢেউ আসতে থাকে। একটা বাঁশঝাড় জড়িয়ে ধরে কোনোরকম বেঁচে যান তিনি।

বন্যায় ঘরহারা। ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে ১ মাসের অধিক সময় ধরে বাঁধেই বসতি হয়েছে লাকী খাতুনের। বড় ছেলে লিমন পড়তো ক্লাস সেভেনে। আনুমানিক ১৩ বছর। গিয়েছিল মাছ ধরতে। মাছ ধরা জাল ফেলার সময় পড়ে যায় নৌকা থেকে। জালের একাংশ বাঁধা ছিল হাতে। নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে স্রোতের তোড়ে আর তীরে উঠতে পারেনি সে। তলিয়ে যায় নিচে।

বড় ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় লাকী খাতুন। ২০ দিন আগে মারা গেলেও মায়ের মন মানে না। ছেলের কথা বলতেই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসে পড়েন। মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। কান্নাজড়িয়ে বলেন, ‘ছাওয়াটা আমার ক্লাস ফাইভে এ প্লাস পাইছিল। খুব পড়া নেকায় ভালো আছিল। এই অল্প বয়সেই সংসারের জন্য কাজ করতিছিল।’

এসব বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জানান, বাঁধেই বাস, খাবারটাও জুটছে না নিয়মিত। সারা দিনে একবার ভাত জোটে। সেই ভাত খান শাকপাতা দিয়ে। ক্ষুধার চোটে ভুলে যান সব। কিন্তু খাবার মিলবে কোথায়? তাদের বাড়িতে এখনো হাঁটু পানি। হঠাৎ পানি ওঠায় কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। বাড়িতে চাল-ডাল থাকলেও তা পচে যায়। বাঁধ ভেঙে এতটাই স্রোত ওঠে যে কোনোকিছু নৌকা দিয়েও আনা সম্ভব হয়নি।

বাতাসী বেগমের বয়স ৯০ বছর। ৪ ছেলে। বিয়ে হয়েছিল ছোট্ট বয়সে। ছিল উঠানওয়ালা বিশাল বাড়ি, গরু, ধানি জমি। সুখের সংসার। হঠাৎ নদীতে বিলীন হয় স্বপ্ন। কঠোর পরিশ্রম করে ফের গড়েন বাড়ি। ভেঙেছে বারবার। ৮ বার তার বাড়ি বিলীন হয়েছে নদীতে।

একেতে নদী ভাঙন তার ওপর প্রতি বছর বন্যা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে তার। চলতে পারেন না। একপা হাঁটলে থমকে যান বারবার। খাবারটাও জুটছে না কপালে। বাঁধে আশ্রয় নিয়ে সাহায্য পেয়েছেন মাত্র একবার। ৮ কেজি চাল। এদিয়ে সংসারের চলে মাত্র ২ থেকে ৩ দিন।

বলেন, ‘বাবারে নদীটাই হামার শউগ শ্যাষ করি দিছে। সোনার সংসার আচিল মোর। গরিব মানুষগুলা খাবার আচ্চিল হামার বাড়িত। আর একন হামরাই মানষেরটে হাত পাতি।’

স্বামীকেও হারিয়েছেন নদীতেই। তিনি জানান, একবার (সালটা মনে করতে পারলেন না) নদী ভাঙা শুরু করেছে। সবাইকে তার স্বামী নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসেন। এরপর বাড়ির গরু আনতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা যান তার স্বামী।

এই কথা বলতেই হাসিমুখটা মেঘাচ্ছন হয়ে যায় এই বৃদ্ধার। জানান, এই নদীটাই সব শেষ করে দিয়েছে তার। কোনোরকম চলছিলেন তার ছেলের পানের ব্যবসায়। করোনার কারণে সেই ব্যবসাতেও টান পড়েছে। জুটছে না খাবার। না খেয়ে থাকাটাই যেন এখন নিয়ম।

বন্যাদুর্গত এলাকায় নতুন সমস্যা ডায়রিয়া। আছিয়া বানুর ঘরে ৩ সন্তান আক্রান্ত। জানান, প্রথমে আক্রান্ত হন তিনি, এরপর ২ ছেলে। ছোট ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ। ৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখনই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না তিনি।

‘বাঁধের পারের বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানে কথা বলে জানা যায়, ডায়রিয়া ও স্যালাইনের ক্রেতা প্রচুর। এছাড়াও খোশপাচড়ার ওষুধও কিনছেন মানুষ।

হামরা গরিব মানুষ। প্রত্যেক বছর কেমনে মাটি ফেলি। আগের বছর বন্যাত সউগ ভাসি নিয়া গেইল। ফির এবার বন্যা। হামরা আর কতো গরিব হমো।’ -এভাবেই দুঃখের কথা বলছিলেন মমতাজ বেগম। তার বাড়িতে প্যারালাইজড ছেলে। কোনোরকম বাড়ি ছেড়ে সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। জানান, আগের বছরের বন্যায় সব হারান। ঋণের টাকায় কোনোরকম বাড়ি করেছেন। ফের নষ্ট হলো সব।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status