শেষের পাতা

প্রতারকের পেটে এক রেমিট্যান্সযোদ্ধার ১০ বছরের সঞ্চয়

রোকনুজ্জামান পিয়াস

৩০ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন

প্রতারক সাইফুদ্দিন মাহমুদ

মোহাম্মদ হাসান। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার গাছুয়া গ্রামের বাসিন্দা। দুবাই ছিলেন সাত বছর। সেখান থেকে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়াতে মোটা অঙ্কের বেতনে কাজ করতেন তিনি। প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা রোজগার করতেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বেশকিছু পুঁজি জমিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় বছর তিনেক অবস্থানের পর ফিরে আসেন দেশে। দেশেই কিছু করবেন- এমনই পরিকল্পনা ছিল তার। সে মতো চট্টগ্রামের হালিশহরে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে সাইফুদ্দিন মাহমুদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিভিন্ন কৌশলে সে হাসানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে তোলে। এক সময় সাইফুদ্দিন তাকে ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। তাতে রাজি হয়ে বিভিন্ন সময় হাসান তার প্রবাস জীবনের সব সঞ্চয় তুলে দেন তার হাতে। এরপর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুটিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় সাইফুদ্দিন। প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝতে পেরে হাসান টাকা ফেরত চান। কিন্তু সাইফুদ্দিন টালবাহানা শুরু করে। টাকা চাইলে আড়ালে থেকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। উপায় না পেয়ে অবশেষে মামলার পথ বেছে নেন হাসান। আসামি করা হয় প্রতারক সাইফুদ্দিন ও তার সহযোগী আবু রায়হানকে। মামলাটি তদন্ত করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দীর্ঘ তদন্তে প্রতারণার সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু সাইফুদ্দিন ও তার সহযোগী রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতারক সাইফুদ্দিন এলাকার কিছু প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বস্বান্ত করছে সহজ-সরল মানুষকে। এদিকে, সহায়-সম্বল হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধা মোহাম্মদ হাসান। যিনি প্রতিবছর লাখ টাকা জাকাত দিতেন, তিনি এখন পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। একমাত্র মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বাকি পড়েছে ঘরভাড়াও। সারাজীবনের সঞ্চয় প্রতারকের পেটে দিয়ে এখন অনিশ্চিত জীবন তার।
ভুক্তভোগী হাসান বলেন, আমি দীর্ঘ ৭ বছর দুবাই ছিলাম। এরপর সেখান থেকে অস্ট্র্রেলিয়া যাই। ৩ বছর পর ভাবলাম, এবার দেশে গিয়ে কিছু একটা করি। দেশে ফেরার পর ২০১৮ সালে সাইফুদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওই সময় সে মেসে থাকতো। পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে যেতো। সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশতো। এতে করে তার প্রতি আমার বিশ্বাস জন্মে। এক সময় সে ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। বলে, ঢাকা থেকে কাপড় এনে চট্টগ্রামে বিক্রি করবো। কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই, আপনি টাকা দিলে দু’জনে মিলে ব্যবসা করতে পারবো। তার এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ধাপে ধাপে তাকে ২১ লাখ টাকা দেই। পরবর্তীতে তার হাতে যখন টাকা চলে যায়, তখন সে তার দুইটা সন্তানসহ স্ত্রীকে হালিশহর নিয়ে আসে। এলাকায় ছোটখাটো দান-সদকাও করতো। এভাবে মোটামুটি নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলে। এভাবে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে একই ব্যবসার কথা বলে টাকা নেয়। কিন্তু কেউ কারোরটা জানতো না। হঠাৎ করে একদিন দোকান বন্ধ করে সকলের অজান্তে এলাকা ছাড়ে সাইফুদ্দিন। পরে তার বাবা ছাবের আহম্মেদকে জানানো হয়। কিন্তু তিনি বলেন, যেহেতু টাকা দেয়ার সময় আমাকে জানাও নাই, তাই এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবো না। ছেলে চিটিংবাজি করে বেড়ায় বলেও অভিযোগ করেন সাইফুদ্দিনের বাবা। হাসান বলেন, এরপর আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করলে গ্রেপ্তার হন সাইফুদ্দিন। পরে তার বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে। হাসানের অভিযোগ, আইনগতভাবে ত্যাজ্য ঘোষণা করলেও পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের তদবিরে সে জামিনে মুক্ত হয়ে বর্তমানে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই রেমিট্যান্সযোদ্ধা বলেন, প্রতারক আমাকে একেবারে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। একবারও ভাবলো না আমার একটি মেয়ে আছে। তার ভবিষ্যৎ কি হবে?
হাসানের ভাই অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মতিউর রহমান জানান, সাইফুদ্দিন মাহমুদ নামে ওই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে তার ভাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, যেকোনো সময় হতাশায় আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিতে পারে। পরিবারের লোকেরা তাকে নিয়ে শঙ্কায় থাকে। প্রতারকের শাস্তি এবং পাওনা ফেরত পেলে হয়তো হাসান আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতো।            
এদিকে পিবিআই-এর তদন্ত সূত্রে জানা যায়, হাসান ২০১৭ সালের ২৭শে মে দেশে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে কিছু করার জন্য চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর হাউজিং এলাকার ‘এল’ ব্লকে বসবাস শুরু করেন। এ সময় ওই এলাকার ‘কে’ ব্লকে পাইকারি ও খুচরা পোশাক বিক্রেতা ‘জামিলা ফ্যাশনের’ মালিক সাইফুদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সাইফুদ্দিন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানাধীন উত্তর পতেঙ্গা এলাকার দক্ষিণ মুসলিমাবাদ সীবিচ রোডের আল আমিন হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা ছাবের আহম্মেদের ছেলে।  পরিচয়ের সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে সাইফুদ্দিন তার দোকানে পুঁজি বিনিয়োগ করে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেন। হাসান এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে বিভিন্ন সময়ে নগদ ও চেকের মাধ্যমে সাইফুদ্দিনকে ২১ লাখ টাকা প্রদান করেন। এ ব্যাপারে ২০১৮ সালের ২২শে অক্টোবর নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ‘যৌথ বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র’ সম্পাদিত হয়। এর একমাস পর অর্থাৎ ২২শে সেপ্টেম্বর হাসান ‘জামিল ফ্যাশন’-এ গিয়ে তালাবদ্ধ দেখতে পান। তিনি সাইফুদ্দিনের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তা বন্ধ পান। দীর্ঘদিন ধরে দোকান বন্ধ থাকায় এবং প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝতে পেরে হাসান একই বছরের ২৫শে নভেম্বর প্রতারক সাইফুদ্দিনের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এরপরও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়ায় তিনি ২০১৯ সালের ১লা জানুয়ারি সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। তার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে মামলায় ঢাকার আদাবরের ৩৭/এ/২-এ বসবাসকারী গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার কুন্দাপাড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা আবু রায়হানকে আসামি করা হয়। তিনি হাসানের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির ভুয়া মামলা দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করতে পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রোকে নির্দেশ দেন। এরপর দীর্ঘ তদন্তে নামে পিবিআই। প্রাথমিক তদন্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, ইতিপূর্বে হাসানের চেক চুরি করে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে সাইফুদ্দিনের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে আবু রায়হান ওই চেক ডিজঅনার করিয়েছেন। এ ঘটনারও সত্যতা পেয়েছে পিবিআই। সকল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ হয়েছে যে, তারা চুরিকৃত ওই চেকে ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে তা খাঁটি হিসেবে ব্যাংকে উপস্থাপন করে প্রতারণা করেছে।      
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রতারক সাইফুদ্দিন দীর্ঘদিন এক জায়গায় বসবাস করে না। বিগত এক বছরের মধ্যে সে বেশ কয়েক জায়গায় অবস্থান করাসহ ঠিকানা পরিবর্তন করেছে। স্থানীয় তদন্তে তার স্বভাব-চরিত্র ভালো নয় বলেও তদন্তে উল্লেখ করা হয়। তার এই অবাধ্য চাল-চলনের প্রেক্ষিতে তার পিতা তাকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণাও করেছে। এ ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মেট্রো পিবিআই-এর উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহেদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমি তিনবার তাদেরকে নোটিশ দিয়েছি কিন্তু তারা হাজির হয়নি। তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পরে আমি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এরপর কি হয়েছে, তা আমার জানা নেই।
সূত্র জানিয়েছে, ইতিপূর্বে প্রতারণার এ মামলায় সাইফুদ্দিন মাহমুদ একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে এলাকার প্রভাবশালীদের তদবিরে ছাড়া পেয়ে যান। ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই সে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এই প্রতিবেদক তার ব্যবহৃত দু’টি মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পায়নি। সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে।  
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু প্রবাসফেরত হাসান নয়, এভাবে অনেকের কাছ থেকেই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক সাইফুদ্দিন মাহমুদ। তবে তারা মামলার ঝামেলায় জড়াতে চাননি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status