প্রথম পাতা

আমলে নেয়া হচ্ছে না কমিটির সুপারিশ

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

১৯ জুলাই ২০২০, রবিবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

দেশে করোনা সংক্রমণের বিস্তার সর্বত্রই। শনাক্তের হারও বেশি। প্রতিদিন এ সংক্রান্ত তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু পরীক্ষা কম হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথায়ও কান দিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। সংস্থাটি বলেছে- টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। দেশে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত দুই লাখ ছাড়িয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সংক্রমণ পরিস্থিতি সামনে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ অবস্থায় এলাকাভিত্তিক বড় পরিসরে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটি। সর্বশেষ আসন্ন কোরবানির ঈদে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে পশুর হাট স্থাপন না করার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কিন্তু রাজধানীসহ উল্লিখিত জেলায় হাট বাসানোর প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধে ঈদের ছুটির সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য স্থানে যাতায়াত বন্ধও রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির দফায় দফায় সুপারিশ দিয়েছে নানা বিষয়ে। কিন্তু এসব সুপারিশ কমই আমলে নিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। কমিটির কয়েকজন সদস্য তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ ১০ই জুলাই ৮টি সুপারিশ দেয় পরামর্শক কমিটি। গত জুন মাসে ৫টি সুপারিশ এবং এর আগে এপ্রিল মাসে দিয়েছিল ৮টি সুপারিশ। পরামর্শক কমিটি কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে করোনাভাইরাসের পর্যালোচনা করেছে। ভাইরাসের সংক্রমণ এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে কমিটি মত দিয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধ জীবন যাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তাদের সর্বশেষ সুপারিশে, ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পরামর্শ দেয়া হয়। কোরবানির ঈদে পশুর হাট বসার ক্ষেত্রে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশে বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে যেন পশুর হাট স্থাপন না করা হয়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পশু কেনাবেচার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য জায়গায় সংক্রমণ প্রতিরোধ নীতিমালা পালন সাপেক্ষে কোরবানি পশুর হাট বসানো যেতে পারে। কোরবানির পশুর হাট শহরের অভ্যন্তরে স্থাপন না করার কথা বলা হয় সুপারিশে। কোরবানি পশুর হাট খোলা ময়দানে হতে হবে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যা ও মানোন্নয়নের জন্য করোনার পরীক্ষাগারের সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে পরীক্ষাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কথা বলেছে। নমুনা দেয়া থেকে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত সময় কমানো প্রয়োজন। পরীক্ষার তথ্য দেরিতে পৌঁছালে আইসোলেশন ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এন্টিজেন বেজড কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতির জন্য ঔষধ প্রশাসনকে পরামর্শ দেয়ার কথা বলেছে কমিটি। এন্টিবডি শনাক্তকরণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্তে বহাল থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া আরটি-পিসিআর টেস্টিং কিট এক প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহের পরিবর্তে কতিপয় প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করে। যাতে করে টেস্টিং কিটের সংকট সৃষ্টি না হয়। এছাড়াও একই ধরনের টেস্টিং কিট এর পরিবর্তে অধিকতর উন্নত এবং সুলভ মূল্যের টেস্টিং কিট জোগাড় এর ব্যবস্থা নেয়া পরামর্শ কমিটির।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ কি পরিমাণ বাস্তবায়ন হয়েছে-জানতে চাইলে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখছি না। সুপারিশে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। হতাশ হয়েছি। সংক্রমণে গুরুত্ব নেই। কোরবানির  ঈদকে সামনে রেখে  কিছু সুপারিশ দেয়া হয়েছিল। তাও বাস্তবায়ন দেখছি না।

জুন মাসে দেয়া পরামর্শক কমিটি সুপারিশে বলেছিল, করোনা রোগের বিস্তার বন্ধ করতে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণলকডাউন দিতে হবে। কমিটি জীবন এবং জীবিকার সামঞ্জস্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সারা দেশে আক্রান্ত ও ঝুঁকির মাত্রার ভিত্তিতে যতটা বড় এলাকায় সম্ভব জরুরিভাবে লকডাউনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে পরামর্শক কমিটি। কিন্তু দেশের বড় কোনো এলাকা এখন পর্যন্ত লকডাউন চোখে পড়েনি। এছাড়া পরামর্শক কমিটি অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে সব হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে চালু করার কথা বলে। হাই-ফ্লো অক্সিজেনসহ চিকিৎসার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল চালুর পরামর্শ দেয়া হয়।

সরকার টেস্টের মানোন্নয়ন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেয় কমিটি। যতদিন সময় কমানো সম্ভব না হয়, পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে সন্দেহজনক রোগীর চিকিৎসা/আইসোলেশন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কমিটি এর আগে ২৮শে এপ্রিল পরামর্শক কমিটির দ্বিতীয় সভায় ৮টি পরামর্শ সুপারিশ করেছিল। হাসপাতাল সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ এর রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্বাচন করাই যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন হবে বলে তারা  মত দেন। হাসপাতালসমূহ মৃদু থেকে মাঝারিভাবে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাখা বাঞ্ছনীয়।

কমিটি সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে শিথিল করার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতালগুলো নিয়োজিত আছে, সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ চিকিৎসক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়োজিত ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত করতে হবে। সুপারিশে বলা হয়, স্বাস্থ্য সেবাকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মান সম্মত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। বিশেষত: যারা মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ও সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তাদের জন্য রেসপারেটরি মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। অধিক সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য পূর্বপরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকার পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি।

বর্তমানে শুধুমাত্র উপসর্গসহ যেসব রোগী কোভিড নির্ণয় কেন্দ্রসমূহে আসেন, তাদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কমিউনিটিতে যে সমস্ত মানুষের উপসর্গ আছে কিন্তু রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে আসছেন না, তাদের খুঁজে বের করে টেস্টের আওতায় আনার সুপারিশ করে পরামর্শক কমিটি। এখন খুঁজে বের করার তো দূরের কথা করোনার পরীক্ষার ফি নির্ধারণের কারণে প্রান্তিক মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

দফায় দফায় কমিটি এমন নানা সুপারিশ করলেও এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক কম। এছাড়া যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে তা ধীর গতিতে। সর্বশেষ দেশে সংক্রমণের হার অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক লকডাউন করার যে পরামর্শ দিয়েছিল তাও পুরো বাস্তবায়ন হয়নি এ পর্যন্ত। সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর রেডজোনগুলো এখনও চিহ্নিত হয়নি। এসব এলাকায় লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।  এর আগে ৬৬ দিন সরকারি ছুটি শেষে অফিস ও গণপরিহন খুলে দেয়ার সময়ও কমিটি ভিন্ন মত দিয়েছিল। ওই সময় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আগে থেকে পরিকল্পনা না নিয়ে এভাবে খুলে দিলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। পরে অবশ্য কমিটির এই আশঙ্কা অনেকটা প্রমাণিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত ১৭ই এপ্রিল ১৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ হলো করোনা বিস্তার রোধে সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status