মত-মতান্তর

নন্দিত রাষ্ট্রচিন্তক প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ

সাঈদ চৌধুরী

১৮ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৮:৪৭ পূর্বাহ্ন

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন নন্দিত রাষ্ট্রচিন্তক। মানুষ ও মানবতার জন্য লড়েছেন আজীবন। অন্য মতাদর্শের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। সভ্যতার বিকাশে রাজনৈতিক বা আদর্শিক মতাদর্শের ভিন্নমতের প্রতি সম্মান ও সৌজন্যবোধ জাগিয়ে তুলতেন। সবকিছুতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। জ্ঞান ও গবেষনার পরিধি অনেক বড় ছিল। চিন্তার ব্যাপকতা ছিল অপরিসীম। এমন বিশাল ব্যক্তিত্বকে বুঝতে হলে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে নয়, রাষ্ট্রচিন্তার বড় পরিসর থেকে দেথতে হবে।

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন ও দর্শনে বিশ্বাসী হলেও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও সম্মান গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিগত তফাৎ এবং আমাদের স্বাতন্ত্র্যের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন।

বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে সঠিক ও সময়োপযোগী পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ আমৃত্যু কথা বলে গেছেন। জাতিসংঘের ৪১তম অধিবেশনে বাংলাদেশকে মর্যাদার সাথে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার কন্ঠ শত নাগরিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে সকল প্রকার হীনতা ও ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিলেন। জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ ভিসি হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছেও সম্মানিত ছিলেন এবং স্মরণীয় হয়ে আছে। ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন তিনি।

এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন বৃটিশ ভারতের অধিভুক্ত মালদাহ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে অবিভক্ত মালদার গোলাপগঞ্জ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। শিবগঞ্জের আদিনা সরকারি ফজলুল হক কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। স্নাতকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেন। এরপর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন।

এমাজউদ্দীন আহমদ রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন। কর্ম জীবনের শুরুতে দুটি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে প্রক্টর ও প্রো-ভিসি ছিলেন।১৯৯২ সালে ভিসি’র দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভিসি ছিলেন। সর্বশেষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ -ইউডার উপাচার্য ছিলেন।

২০১৮ সালে ইউডা থেকে অবসর গ্রহণ করলেও একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে গণমাধ্যম ও গবেষনার জগতে সরব ছিলেন। সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখতেন। সভা-সেমিনারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তাঁর গবেষণা গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে শতাধিক বই লিখেছেন।

গ্রন্থগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথা (১৯৬৬), মধ্যযুগের রাষ্ট্র চিন্তা (১৯৪৫) তুলানামূলক রাজনীতি: রাজনৈতিক বিশ্লেষণ (১৯৮২), বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকট (১৯৯২), সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৩), গণতন্ত্রের ভবিষৎ (১৯৯৪), শান্তি চুক্তি ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৯৮), আঞ্চলিক সহযোগিতা, জাতীয় নিরাপত্তা (১৯৯৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০০) উল্লেখযোগ্য ।

প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের লেখা পাঠ্যবইগুলোও বেশ জনপ্রিয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত তাঁর অনেক বই বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি গ্রামার বই লিখেছেন। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই লিখেছেন।

সৃজনশীল লেখার জন্য এমাজউদ্দীন আহমদ দেশে-বিদেশে সম্মানিত হয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোল্ড মেডেল, শেরেবাংলা স্মৃতি স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ যুবফ্রন্ট গোল্ড মেডেল, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম স্বর্ণপদকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ চলে গেছেন তার স্থায়ী ঠিকানায়, মহান মাবুদের কাছে।ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ’ন। ১৭ জুলাই শুক্রবার ভোররাতে ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন তিনি। আগের রাত ২টার দিকে শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভোর ৫টায় হার্ট অ্যাটাক করেন। হাসপাতালে নেয়ার আগে অসুস্থতার কোনো আলামত ছিল না বলে পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সেলিমা আহমদ ২০১৬ সালে ইন্তেকাল করেছেন। অধ্যাপক দিলরুবা শওকত আরা ইয়াসমিন ও অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন তার দুই কন্যা। দুই ছেলের মধ্যে জিয়া হাসান ইবনে আহমদ সরকারি কর্মকর্তা, তানভীর ইকবাল ইবনে আহমদ একজন চিকিৎসক।

প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষন ও সত্য সাধনা করে গেছেন।সত্যের এই সাধকের মৃত্যু অপুরণীয়। মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।


- ফেসবুক থেকে নেয়া
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status