বিশ্বজমিন

ভারত-চীনের বৈরিতা যখন তুঙ্গে তখন চোখ রাখতে হবে বাংলাদেশের দিকেও

ড. আলী রিয়াজ

৩ জুলাই ২০২০, শুক্রবার, ২:৪০ পূর্বাহ্ন

চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও অচলাবস্থা সামনে নিয়ে এসেছে দুই দেশের মধ্যেকার দীর্ঘকালীন বৈরি সম্পর্ক। তবে একইসঙ্গে এই উত্তেজনা ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কের বিষয়টিকেও আলোচনায় তুলে এনেছে। এর আগে পাকিস্তান ছাড়া প্রতিবেশি প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র থেকেই সমর্থন পেত ভারত। কিন্তু এবার সবাই চুপ হয়ে রয়েছে। উল্টো নেপালি পার্লামেন্ট ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত জায়গাকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে মানচিত্র প্রকাশ করেছে।

এদিকে, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে চীন। বেইজিং এর সুবিধা ও লাদাখে ভারত-চীনের সীমান্ত সংঘর্ষের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে, কীভাবে ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশকে দেয়া চীনা সুবিধাকে তুলে ধরছে। ভারতীয় কোনো একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ঢাকার অবস্থানকে অসম্মানজনকভাবে তুলে ধরা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে বাংলাদেশে। এক পর্যায়ে গণমাধ্যমটি বাধ্য হয়েছে ক্ষমা চাইতে।

এমন প্রতিক্রিয়া আবারো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশিদের অস্বস্থির বিষয়টিকেই প্রকাশ্যে নিয়ে আসলো। যদিও দুই দেশের সরকারই দাবি করছে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সোনালি যুগে প্রবেশ করেছে। তবে বাংলাদেশিদের একটি অংশের ধারণা, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে একতরফাভাবে লাভবান হচ্ছে ভারতই। গত মার্চ মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়েও একই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বাংলাদেশিদের মধ্যে। তবে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ওই সফর বাতিল হয়ে যায় তখন।
গত কয়েক মাস ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, চীন বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রভাব বৃদ্ধি করেছে এবং বাংলাদেশ এখন ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।

সন্দেহাতীতভাবেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ, এদেশে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন এবং দেশটি থেকে সাবমেরিনও ক্রয় করেছে বাংলাদেশর সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক কয়েক বছর পূর্বেও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের মতো গুটি কয়েক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত এক দশকে অবস্থার দারুণ পরিবর্তন এসেছে। ভারতকে ছাড়িয়ে চীন এখন বাংলাদেশের সবথেকে বড় বাণিজ্য সহযোগি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

চীনের সঙ্গে এ সম্পোর্কন্নয়ন ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহবান জানান। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে। দেশে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, ভারতের সাহায্য ছাড়া ২০১৪ সালের ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে যেত। গত এক দশক ধরে ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও বৃদ্ধি করেছে ভারত।

তবে এটি বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে যথেষ্ট ছিল না। সম্পর্কের জন্য বাংলাদেশ তার নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য শুল্কমুক্ত ট্রানজিট, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে নজরদারি সিস্টেম স্থাপন ও ফেনি নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের অনুমোদনসহ বেশ কিছু বিষয়ে ভারতকে সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত হয়ত একটি ধারণা পেয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক যতটাই ভারসাম্যহীন থাকুক না কেনো ঢাকা দিলি­র প্রভাব বলয়ের মধ্যেই থাকবে। তবে এখন বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি ভারতের জন্য অস্বস্থির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো অবশ্য বাংলাদেশের এমন নীতির বিরোধীতা করতে চীনের ঋণের ফাদের ভয় দেখাচ্ছে। ২০১৪ সালের পর থেকেই মূলত চীনের সঙ্গে ভারতের এক ধরণের বৈরিতা শুরু হয়। উভয় পক্ষই তখন থেকে বাংলাদেশে নিজের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিল। তবে ভারতীয় নীতি ছিলো স্বল্প সময়ের জন্য এবং শাসকদল আওয়ামীলীগের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু চীন তখন থেকেই দীর্ঘ পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে এগিয়ে গেছে।

অনেকেই শেখ হাসিনার এই ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার অনেকেই অবাক হয়েছেন যে, কেনো দীর্ঘকাল সমর্থন পেয়ে আসা এক মিত্রকে হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন তিনি। তবে এটি এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করতে চীনকে প্রয়োজন। বিশেষ করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য। আবার এমনটাও হতে পারে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। যেখানে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা থাকবে অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে।

বলা হয়ে থাকে, দুটি ‘বিতর্কিত’নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে নৈতিক বৈধতার সংকট রয়েছে শাসক দল আওয়ামীলীগের। সরকার এই বৈধতা অর্জনের দিকেই এখন মনোযোগি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন গণতন্ত্রের ঘাটতি পুষিয়ে নেবে এমনটা আশা করা হচ্ছে। তবে বর্তমানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে এ আশাও ফিকে হয়ে আছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। অপরদিকে মহামারি চলাকালীন দারিদ্রতার হার বৃদ্ধিও আওয়ামীলীগের অর্থনৈতিক কৌশলের দুর্বলতা স্পষ্ট করেছে। তবে এখনো শাসক দল অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের সমর্থন পাবার কৌশল ধরে রেখেছে।
কর্তৃত্ববাদের প্রতি ঝোঁকের কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের থেকে চীনের প্রতি বাংলাদেশের আগ্রহ বেড়ে চলেছে। সন্দেহাতীতভাবে আগামি কয়েক মাসে ভারত ও চীনের মধ্যেকার বৈরিতা দক্ষিণ এশিয়ায় আরো প্রবল হয়ে উঠবে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে থেকে এই বৈরিতার ভবিষ্যৎ দেখার জন্য বাংলাদেশই হবে আদর্শ স্থান।

(ড. আলী রিয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনইজ স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status