মত-মতান্তর

বাংলাদেশের জার্নাল

আরোপিত ও জন্মগত সম্পর্কের নির্মম পরিণতি!

যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

৫ জুন ২০২০, শুক্রবার, ৬:১৭ পূর্বাহ্ন

ভেতরে ভেতরে আমাদের কার কী অবস্থা বাইরের লোকজন না জানলেও আমরা নিশ্চয়ই জানতাম। হয়তো কেউ কেউ অবচেতন মনে জানলেও তা প্রকাশ করতে পারতেন না। এখন আমাদের সেই প্রকাশের সময় এসেছে। আমরা প্রকাশ করছি। আমরা ঘোষণা করছি পৃথিবীতে কেউ কারো নয়।

মনুষ্যত্বের আড়ালে আমাদের কারো কারো ভেতরে যে অমানবিকতার ডালপালা ছড়িয়ে আছে তা করোনা না আসলে হয়তো বুঝতে পারতাম না।

গত একমাস ধরে বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর নির্দিষ্ট কিছু রিপোর্ট আমি ফলো করছিলাম। বলতে পারেন ফলো করতে বাধ্য হচ্ছিলাম। দেখতে চাইছিলাম আমরা কী দাবি করি এবং কী করছি। মানুষ হিসেবে আমরা যে দাবি করে আসছিলাম তা আসলে কতটুকু সঠিক? সেই বিষয়টি আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম।

আমি দেখতে চাইছিলাম আমরা কতটুকু নিচে নামতে পারি। আমার সেই পর্যবেক্ষণ আপাতত শেষ হয়েছে। মনুষ্যত্বের আড়ালে আমাদের ভেতরের অন্ধকার দিকের পর্যবেক্ষণ আমার এই মুহূর্তে শেষ হয়েছে। আমাদের ভেতরের অন্ধকার দিকটা ভয়াবহ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে এতোদিন আমরা যা দাবি করতাম করতাম তা শুধু ফাঁকা বুলি ছিল। আমরা আসলে যা বলি তা নই।পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কিছু করতে হয় এবং বলতে হয়। আমরা তাই বলছিলাম এবং করছিলাম। আসলে আমাদের ভেতর ছিল অন্তঃসারশূন্য ধু ধু মরুভূমি। আমরা মনুষ্যত্বের কাতার থেকে অনেক পেছনে পড়েছিলাম। করোনা মহামারীতে এসে আমরা সেই প্রমাণ দিয়েছি।

অন্ধকারের কোন দিকটি আমরা উন্মোচিত করিনি? সবগুলো দিকই উন্মোচন করেছি। জন্মগত বা আরোপিত সম্পর্ক দুটি যে মাঝেমধ্যে খুব ঠুনকো হয়ে যায় তার প্রমাণ আমরা দিয়েছি।

জন্মগত সম্পর্ক বলতে আমি মা-বাবা, ভাই-বোন ছেলে-মেয়ের সম্পর্কের কথা বলছি।আরোপিত বা অর্জিত সম্পর্কে বলতে আমি স্বামী-স্ত্রীর, শশুর শাশুড়ির সম্পর্কের কথা বলছি।

ঘটনাটি প্রথমে শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে। একজন পরিচিত গিটারিস্ট করোনার উপসর্গ নিয়ে কয়েক হাসপাতাল ঘুরে কোথাও ভর্তি হতে না পেরে যখন বাসায় ফিরে আসেন তখন সে রাতেই তিনি শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান। জন্মগত এবং আরোপিত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরা তার সেই লাশ বাসা থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে রাখেন। নিমিষেই আমাদের সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে গেল! প্রিয় স্বামী, প্রিয় ভাই বা সন্তানকে বাসায় না রেখে আমরা রাস্তায় ফেলে রাখলাম! অবশ্য ওনার কপাল ভালো উনার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। জীবিত অবস্থায় উনাকে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়নি।


অবশ্য আমার এ ভুল ভাঙতে সময় যায়নি। পরের সংবাদে দেখলাম করোনা উপসর্গ সন্দেহে আপন সন্তানরা তার জীবিত মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে এসেছে। আমরা কত নিচে নেমে গেলাম। কতো অন্ধকারে আমরা হারিয়ে গেলাম। জন্মদাত্রী মাকে জ্বর আর কাশি থাকার কারণে জীবিত অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে আসলাম যারা আমরা কি মানুষ?একটু খেয়াল করে দেখুন আপনার সন্তানরা যদি আপনাকে এভাবে জঙ্গলে রেখে আসে তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে? মানবতার কি ভয়াবহ পরিণতি! জন্মগত সম্পর্কের কি নির্মম ট্রাজেডি!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা সন্দেহ ভর্তি হবার পর স্বামী মারা গেছেন। লাশ ফেলে প্রিয় স্ত্রী এবং বাদবাকি আত্মীয়-স্বজন পালিয়ে গেছেন। আরোপিত সম্পর্কের কি ভয়াবহ পরিণতি!

ফেনীর সোনাগাজীতে ৫৫ বছর বয়সে শাহাব উদ্দিন সাহেবের কপালটা আরো খারাপ। জ্বর কাশি এবং শ্বাসকষ্ট ওঠায় ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ রেখে তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং জামাতা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। তালাবদ্ধ ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আহারে জীবন!

টঙ্গীতে করোনা সন্দেহে দুই শিক্ষকের মৃত্যু। পাঁচ তলায় লাশ পড়ে আছে। কেউ নামাতে এগিয়ে আসছে না। আহারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা!

করোনা সন্দেহে মারা যাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিকের লাশ আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামবাসী তিস্তায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে জানা গেল তার করোনা ছিল না। ততক্ষণে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা আমাদের পশুত্বের প্রমাণ দিয়ে দিয়েছি!

অসুস্থ মাকে রাস্তায় ফেলে দিল প্রবাসী দুই ছেলের স্ত্রী। আরোপিত সম্পর্কের ভয়াবহ পরিণতি। নিজের সন্তানরা যেখানে মাকে জঙ্গলে ফেলে আসছে সেখানে সন্তানের স্ত্রীরা এমনটা করলে আপনার নিশ্চয়ই খুব অবাক হবেন না!

করোনা সন্দেহ থাকা মৃত ব্যক্তির কবর খুঁড়তে রাজি হননি এলাকার মানুষ। কবর খুঁড়তে গেলে তো আপনার করোনা হবে না। আপনি কেন এমন নির্মম হলেন? আপনার বুঝি করোনা হতে পারে না?

কারাগারে থাকা করোনা রোগীর মৃত্যু হলে করোনা সন্দেহে আত্মীয়-স্বজন গ্রহণ করেনি। হায়রে সম্পর্ক!

উপরের কাহিনীগুলো হলো আমাদের চারপাশে গত কয়েক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া জন্মগত এবং আরোপিত সম্পর্কের কিছু নির্মম এবং ভয়াবহ উদাহরণ।

আমরা কোথায় গেলাম? আমাদের কোথায় যাবার কথা ছিল? আমাদের মনুষ্যত্ব এতো নিচে নামল কীভাবে? এই প্রশ্নগুলো কয়েকদিন থেকে থেকে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জবাব পাচ্ছি না। মনুষ্যত্ব আর মানবিকতাকে জাগ্রত করার জন্য যে অবলম্বনকে আমরা এতোদিন উৎসাহিত করেছি তা আসলেই কোন অবলম্বন নয়। করোনা এসে তাই বলে যাচ্ছে।

বারবার একটি কথাই আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে।ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে আমাদের যে সম্পর্কগুলো তা আসলেই খুব ঠুনকো। বালির বাঁধের মতো। নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসে। চোখ বুজলেই আপনি টের পাবেন আপনি যাদের জন্য জীবন যৌবন খরচ করেছেন তারা আসলে আপনার কেউ নয়। তারা ছিল আপনাকে ঘিরে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আপনি এখন নেই। আপনার প্রয়োজন নেই। আপনি এখন কবরের বাসিন্দা। কবরে যাবার আগেই আপনার জীবনকে গোরস্থান করে ফেলেছে আপনার প্রিয় আত্মীয়-স্বজন। আপনি তাদের জন্য ছুটছেন? কোথায় ছুটছেন?

কাদের জন্য আপনি ছুটে চলছেন? কাদের জন্য আপনি মানুষকে কষ্ট দিয়ে নিজের পরিবারকে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন? একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন। হঠাৎ করোনা এসে আপনাকে স্পর্শ করলে আপনার পরিণতি কী হবে? একটু ভাবুন। সময় না থাকলে কিছু সময় নিয়ে চিন্তা করুন। আসলেই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। করোনা এসে সেই নির্মম সত্যটা কি আবার প্রমাণ করে দিচ্ছে?


ডা: আলী জাহান
বিলেতে কর্মরত বাংলাদেশী চিকিৎসক (সাইকিয়াট্রিস্ট)
ইমেইল- [email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status