অনলাইন

করোনায় করুণ অর্থনীতি, আমাদের করণীয়

ডালিয়া রহমান

২০২০-০৬-০১

করোনাভাইরাস ব্যাপক বিস্তারের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন বড় ধরণের বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে যে, বৈশ্বিক লকডাউনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এবছর তিন শতাংশ সংকুচিত হবে। কিন্তু এর আগে তারা ঠিক পুরো উল্টো ধারণা করে বলেছিল যে, এবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে তিন শতাংশ। বলা হচ্ছে, ঊনিশশো তিরিশের দশকে যে বিশ্ব মহামন্দা পরিস্থিতি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তারপর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধ্বস নেমেছে। করোনা মহামারি বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিবে বলে সতর্ক করেছে অক্সফাম। তাদের দৃষ্টিতে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও গভীর। হিসাব করে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম দেশ-জাতি নির্বিশেষে বৈশ্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে। অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে ১৯৯০ দশকের আগের পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারে বলেও অর্থনীতি বিশ্লেষকগণ আশঙ্কা করছে। ‘যারা দিন আনে দিন খায়’তাদের অবস্থা আরও করুণ হবে বলেও শঙ্কা হচ্ছে। ধনী দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হয়তো কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি চাঙ্গা না হলে উন্নত দেশগুলো তাদের বিনিয়োগের তেমন সুফল পাবে না।

অর্থনৈতিকভাবে এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ চীন। করোনা পরিস্থিতির জেরে ২০২০ সালে কোনও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টার্গেট রাখছে না এই দেশ। গত ৩০ বছরে এই প্রথম সেই টার্গেট ঠিক করা হলো না। চীন আগেই জানিয়েছিল, করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি নিম্নগামী হয়েছে। প্রথম কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধিও কমেছিল। সে কথা মাথায় রেখে এবং জনজীবনে গতি আনতেই এ বছর চীন এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবদদের একাংশ।

এই প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ থেকে নেমে দুই বা তিন শতাংশ হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত গত একমাসে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে কৃষি, সেবা এবং শিল্পখাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবাখাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্পখাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান এখন ১৪ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮.২ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, এখন একই মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে দুই থেকে তিন শতাংশ। যদি এই অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে ২০২১ সালে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হচ্ছে ভোক্তা ব্যয়। অর্থাৎ বিভিন্ন খাতে মানুষ যে টাকা খরচ করে সেটার ওপর নির্ভর করেই বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও টিকে আছে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত- অর্থবছরের এক-তৃতীয়াংশ করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এ জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ভোক্তা ব্যয় আমাদের জিডিপির ৬৯ শতাংশ। এই ব্যয় যদি করা সম্ভব না হয়, এই ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল যারা আছেন, ছোট উৎপাদক থেকে শুরু করে শিল্পখাতে এবং সেবাখাতে সবাই বিক্রির সংকটে পড়বে। এই প্রান্তিকে বাংলাদেশে ভোক্তা ব্যয়ের যে দুটো উৎসব আছে, একটি হচ্ছে রমজান মাস ও ঈদ এবং অন্যটি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ এরমধ্যে পহেলা বৈশাখ আমরা সম্পূর্ণভাবে মিস করেছি। রমজান এবং রমজানের ঈদ মিস না করলেও ভোক্তা ব্যয় বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বছর সর্বনিম্ন বলে দোকান মালিক সমিতি জানিয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়ায় মানুষ তাদের চাকরি এবং ব্যবসা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় খরচ করার ক্ষেত্রে এখন মানুষ বেশ সাবধান। অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া এখন মানুষ অন্য কিছু কিনতে চাইছে না। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৮০ লক্ষ শিল্প উদ্যোগ আছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। বাকি দুই শতাংশ শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, করোনাভাইরাস বিস্তারের সময় থেকে শুরু হবে এ পর্যন্ত অর্থাৎ গত দুইমাসে তাদের তিনশ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রায় ৩২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সেখানে যদি শিল্পের অবদান হয় ৩৫ শতাংশ এবং সেটার ৯৫ শতাংশই এখন বন্ধ, এই তিনমাসে যা উৎপাদন হতে পারতো সেটা আর হচ্ছে না।

পশ্চিমা অর্থনীতির উন্নয়ন বা অবনমণের সাথে বাংলাদেশের ভাগ্যও জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, গার্মেন্টস রপ্তানি এবং রেমিটেন্স- এ দু’টো মিলিয়ে বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৮ শতাংশ। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য এবং রেমিটেন্স- এ দু’টো জায়গায় আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কারণ মূল আমদানিকারক দেশগুলোও করোনা আক্রান্ত এবং সেখানে কর্মসংস্থান এখন অনেকবেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সুতরাং এই দেশগুলোতে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের চাহিদা ফিরে আসতে সময় লাগবে। সেসব দেশে অনেক বাংলাদেশি এখন যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই করোনা পরবর্তীকালে ফিরে আসতে বাধ্য হতে পারে। কারণ সেখানে শ্রমিক ছাঁটাই হবে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে প্রায় ৯২,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব প্রণোদনা তখনই কাজে লাগবে যখন বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে চলবে। শুধু দুঃস্থদের জন্য খাদ্য সাহায্য নয়, অনানুষ্ঠানিক খাতের যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের জন্য ন্যূনতম আর্থিক সাহায্য প্রদান করে তা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আগামী ৬ মাসের জন্যে এ ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী অর্থবছরে চলমান সুরক্ষা-বেষ্টনির আওতাভুক্ত পরিবারগুলোর সংখ্যা এবং আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিষ্প্রভ অর্থনীতিতে এই টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখবে এবং তা অর্থনীতি পুনর্জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এর সাথে সম্পর্কিত এনজিওদের মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম। এই মুহূর্তে প্রায় ৪৩৪.৬ বিলিয়ন টাকা (জিডিপির ১.৫ শতাংশ) ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঘুরছে। এদের কার্যক্রম বন্ধ করা বা কাজ করতে না দেয়া হবে আত্মঘাতী। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে এনজিওরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। নারীর ক্ষমতায়নেও এদের অবদান অনস্বীকার্য।

করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ ও যথাযথ চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিয়েই অর্থনীতিকেও সচল করতে হবে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অধিক সংখ্যক বেসরকারি হাসপাতালকেও করোনা চিকিৎসার উপযোগী করতে হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পর্যায়ক্রমে সব শিল্পকারখানা, বন্দর, আমদানি-রপ্তানি চালু করা হলে ব্যবসায়ী-কর্মচারিরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেসব অর্থনৈতিক খাত এখনই চালু করা সম্ভব হবে না, সেসবের শ্রমিক কর্মচারিদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে হবে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ বাংলাদেশেও আসতে পারে। সে জন্য কৃষি, পোলট্রি, ডেইরি সেক্টরে উৎপাদন ঠিক রাখার পাশাপাশি বাজারজাতকরণের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে এবং দ্রুত বিভিন্ন খাতের উৎপাদন চালু করতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ করা সরকারি অর্থের ব্যয় যথাযথ হওয়া নিশ্চিত হলে কর্মসংস্থান ও কেনাবেচার পাশাপাশি সরকারি রাজস্বের সংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসবে, এটাই এখন কাম্য।

করোনাভাইরাস মানুষকে পরিবর্তন করছে। বদলে যাচ্ছে তার জীবন-যাপন। তার ব্যবহার। তার চিন্তা ও আকাঙক্ষা। বদলে যাচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। সৃষ্টি হয়েছে জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্ব। অর্থনীতি জীবন-জীবিকার বিশ্লেষণে অন্যতম শাখা হিসেবে আবির্ভূত ও বিকাশ লাভ করেছে, গত প্রায় তিনশ বছর ধরে এবং দিন দিন তা পরিপুষ্ট হয়েছে দর্শন ও গণিতের সমন্বয়ে। জীবনের তাল ও জীবিকার অংক মিলেমিশে একাকার হয়েছে। কখনও এই মিলন সুরের এক ঐকতান সৃষ্টি করেছে আবার কখনও তা বেসুরো হয়েছে। প্রযুক্তির বিকাশ এই মিল-অমিলে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। বর্তমানে পুরো পৃথিবী বিপর্যস্ত। করোনাভাইরাস দেশ দেখছে না। ধনী-দরিদ্র দেখছে না। বদলে যাচ্ছে, যাবে বৈশ্বিক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক।

এ প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিকে বদলে যেতে হবে। অর্থনীতি জনকল্যাণে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের বিজ্ঞান। করোনাভাইরাস সনাতন অর্থনীতির ‘সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার’-এর ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মুনাফা, লোভ, প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে সামনের দিনগুলিতে অর্থনীতির ভিত্তি হতে হবে জনকল্যাণ, উদ্বৃত্তের সমবন্টন, সহযোগিতা। অর্থনীতিকে তার খোলস পরিবর্তন করতে হবে। হতে হবে স্বাস্থ্য-বান্ধব, পরিবেশ-বান্ধব, শ্রম-বান্ধব এবং দরিদ্র-বান্ধব। তা হলেই অর্থনীতি হবে মানব-বান্ধব। ধরিত্রী-বান্ধব।

(লেখক: চেয়ারপারসন, আগ্রহ )
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status