প্রথম পাতা

আম্ফানের থাবা

স্টাফ রিপোর্টার

২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

আম্ফান। শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গতকাল বিকালে আঘাত হানে বাংলাদেশের উপকূলে। বিকাল ৪টার দিকে এটি উপকূলে আছড়ে পড়ে। এর আগে থেকেই অবশ্য আম্ফানের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয় উপকূল অঞ্চলে। ঝড়ে লণ্ডবণ্ড হয়ে যায় গাছপালা। এতে একজন মারাও গেছেন। নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইতে থাকে। বাংলাদেশের উপকূল এলাকা অতিক্রমের সময় শুরুতে আম্ফানের গতিবেগ ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটারের মধ্যে। বিকাল থেকেই আম্ফান তাণ্ডব চালায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে নেমেই পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাণ্ডব চালায়। ঝড়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে যায়। অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কলকাতার রেড রোড, নিউ আলিপুর, খিদিরপুরে আম্ফানের তাণ্ডবে গাছ উপড়ে পড়ে। সেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯০ কিলোমিটার।

পশ্চিমবঙ্গে যখন আম্ফানের তাণ্ডব চলে তখন বাংলাদেশের উপকূল এলাকায় ধমকা বাতাস ও বৃষ্টি দেখা দেয়। জোয়ার বৃদ্ধি পায় আশঙ্কাজনকভাবে। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, এর প্রভাবে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ভারী বর্ষণ হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে ৬-৮ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আগেই সতর্ক করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয় বুধবার সকাল থেকেই। গতকাল দুপুরেই আম্ফানের জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামে এক যুবক মারা গেছেন। বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দীপে এ ঘটনা ঘটে। দুপুর ১২টার দিকে নদীর তীর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি ও স্র্রোত বেড়ে গেলে তীরে থাকা সালাউদ্দিন ভেসে যান বলে স্থানীয়রা জানান। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ঝড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে ছিদ্দিক ফকির (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা থানার প্রধান সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় বয়স্ক ভাতা আনার জন্য ভাড়া করা মোটরসাইকেলে তিনি উপজেলা সদর চরফ্যাশনের দিকে যাচ্ছিলেন। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় একজন মারা গেছেন।  তিনি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি দলের সদস্য ছিলেন বলে জানা গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদ-নদী সমুদ্র যখন উত্তাল ঠিক তখন একটি খাল দিয়ে নৌকায় যাচ্ছিলেন তিনি। দমকা হাওয়ায় নৌকা থেকে পড়ে যান তিনি। পরবর্তীতে তার মৃত্য ঘটে।
গতকাল সকাল থেকেই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা কালো মেঘে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। বৃষ্টি হতে থাকে বিভিন্ন এলাকায়। সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। বিকাল থেকেই উপকূলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানি বেড়ে যায়। এতে নিম্নাঞ্চল ও অরক্ষিত বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হতে থাকে। বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা হাজার হাজার বাড়ি-ঘর পানিতে ডুবে  যায়। এসব এলাকা থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মহাবিপদ সংকেত জারি হওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্দরে জারি করা হয়েছে ‘চার মাত্রার সতর্কতা’। জেটি থেকে সব জাহাজ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যন্ত্রপাতিও সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যাতে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত সব বড় জাহাজকে গভীর সমুদ্রে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সব লাইটারেজ জাহাজ শাহ্ আমানত সেতু সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে নোঙ্গর করে বন্দর চ্যানেল ক্লিয়ার রাখা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি  (বুধবার) দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর  থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে সুন্দরবনের নিকট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সমুদ্র অত্যন্ত উত্তাল জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর খুবই উত্তাল।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিসহ ঘণ্টয় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তা-ব থেকে রক্ষা পেতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ মানুষকে ১৪ হাজার ৬৩৬টি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২টি গবাদিপশুকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। একটি লোকও যেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় না থাকে সরকারের তরফে সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। একইভাবে এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সশস্ত্র বাহিনীও। প্রস্তুত রাখা হয়েছে মেডিকেল টিম, ওষুধ, খাবার, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে উদ্ধার তৎপরতার জন্য এয়ার ক্রাফট ও হেলিকপ্টার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status