শেষের পাতা

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগী চিকিৎসা কীভাবে

ফরিদউদ্দিন আহমেদ

১৭ মে ২০২০, রবিবার, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

দেশে প্রতিদিনই করোনার রোগী বাড়ছে। এতে মানুষের মধ্যে শঙ্কাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা মোকাবিলার নামে রীতিমতো যেন ভেঙ্গে পড়েছে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। সাধারণ জ্বর-কাঁশি তো নয়ই, ক্যানসার, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না হাসপাতালে। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে করোনার সংক্রমণ চরম আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

এদিকে চিকিৎসার আশায় ছুটছে মানুষ। সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সংকট। যদিও জরুরি ভিত্তিতে সরকার ২ হাজার চিকিৎসক ও ৫ হাজারের উপরে নার্স নিয়োগ দিয়েছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে ৬শ’ চিকিৎসকসহ ১৫শ’র বেশি স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দেড় হাজারের উপরে কোয়ারেন্টিনে আছেন। ফলে চিকিৎসা সেবায় বিঘœ দেখা দিয়েছে সর্বত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মাসেই করোনার রোগী ৫০ হাজার ছাড়াতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে করোনার সংক্রমণ চরম আকার ধারণ করতে পারে। এমনই  পূর্বাভাস দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পরবর্তী বেশ ক’দিন এই পরিস্থিতি স্থির থাকতে পারে। তারা প্রত্যাশা করেছেন জুন মাসের শেষ নাগাদ সংক্রমণের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে। বাংলাদেশে মহামারির প্রবণতা বিশ্লেষণে সরকার গঠিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মহামারি প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আমাদের দল পূর্বাভাস দিয়েছে যে, চলতি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহটি কভিড-১৯ সংক্রমণের চরম সময়কাল হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের  সাবেক মহাপরিচালক ও আট সদস্যের কমিটির একজন সদস্য ডা. হোসেন আরো বলেন, তাদের বিশ্লেষণ অনুসারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখানোর আগে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণের চরম সময়কাল চলবে। গাণিতিক পদ্ধতি এবং মহামারিবিদ্যার সূত্রের ভিত্তিতে তাদের বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জুনের শেষের দিকে (কভিড-১৯ সংক্রমণের হার) দ্রুত কমতে থাকবে বলে আশা করা যেতে পারে। দেশে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ এবং বর্ধিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত প্রতিদিনের সংক্রমণের রিপোর্টে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কার মধ্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। অধ্যাপক হোসেন বলেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই তিনটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে-মানুষকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, হাত ধুতে হবে এবং শারীরিক দূরত্ব কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে।

আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা ডা.  মোস্তাক হোসেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, লকডাউন শিথিল করা উচিত হবে না। দোকানপাট খোলার হটকারি সিদ্বান্ত নিলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এখনও বিস্ফোরণ ঘটেনি। ছোট ছোট ওঠা নামার মধ্যে আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধীরে ধীরে ছোট শিল্প কারখানা খুলতে হবে। ঈদের বাজার খুললে বিপদ হবে। যদিও পুরো বাংলাদেশই কভিড-১৯ এর ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে, দেশের অনেক জায়গায় সংক্রমণের হার এখনো খুব কম আছে এবং ভাইরাসের বিস্তার আটকাতে হলে আমাদের করোনা ভাইরাস ক্লাস্টার শনাক্ত করতে হবে এবং সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসা দিতে হবে। তাহলে রোগী কমে আসবে। আমরা যদি সমস্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই ক্লাস্টারগুলো পরিচালনা করি, তবে রোগের বিস্তার ধীরে-ধীরে হ্রাস পাবে। তিনি আরো বলেন, জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে শহরগুলো এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে শারীরিক দূরত্বকে নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। যে কারণে এইসব অঞ্চলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। তিনি রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং সাভারের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের পদক্ষেপের পরামর্শ দেন। কারণ এই অঞ্চলগুলোকে কভিড-১৯ এর প্রভাবিত সবচেয়ে খারাপ এলাকা হিসাবে দেখা যাচ্ছে। ডা. মোস্তাক আরো বলেন, যদি এই ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে জুলাই-আগস্টের শেষের দিকে পূর্বাভাস অনুযায়ী স্বস্তির প্রত্যাশা করতে পারেন।

করোনার রোগী আরো বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে কিনা জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ মানবজমিনকে বলেন, পরীক্ষা বাড়ছে। রোগীও বাড়বে। একজনের কাছ থেকে অন্যজনে ছড়াচ্ছে। একের অধিক সংখ্যা হবে। সংখ্যা কমের দিকে যাবে না। সরকারি হাসপাতালে ৩টি ভাগে কাজ করছে। জরুরি বিভাগ থেকে আইসোলেশন করা হচ্ছে। নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কভিড-১৯ হলে তাকে করোনার সুবিধা দিচ্ছে। না হলে অন্য বিভাগে নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে করোনা রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদেরকে শনাক্ত করা। ১৪ দিনে রোগীর সংস্পর্শে কারা এসেছেন তাদেরকে নির্ণয় করার বিষয়টি বিশাল কর্মকা-। তাদেরকে শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন করতে পারছেন কিনা। করতে না পারলে সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে সকলকে সম্পৃক্ত করতে হবে। করতে পারলে রোগী কমবে। প্রয়োজনে হাসপাতাল বাড়বে। তাতে লাভ হবে কম। সকলকে সম্পৃক্ত করতে পারলে সুফল বেশি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার হ য ব র ল চিত্রেরই খবর আসছে। করোনার চিকিৎসা না পাওয়া অন্যদিকে করোনার আতঙ্কে হাসপাতালগুলোকে সাধারণ জ্বর-সর্দি, কাঁশি এমনকি ক্যানসার, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেলেও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলছে না কোন চিকিৎসা। জ্বর-সর্দি, কাঁশি হলেই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন এই ভয়ে চিকিৎসকরা দিচ্ছেন না চিকিৎসা। করোনা আক্রান্ত রোগী এসেছেন কিংবা করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন এমন সন্দেহে হাসপাতাল ছেড়ে ডাক্তারের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দুই সপ্তাহ আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) করোনার টেস্ট করাতে এসে টেস্ট না করিয়ে এবং চিকিৎসা না পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়েই মারা গেছেন আবদুর রাজ্জাক নামের মোহাম্মদপুরের এক কাপড় ব্যবসায়ী। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে এখনো এতো মহামারি আকার ধারণ করেনি। কিন্তু করোনার কারণেই গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা ভেঙ্গে পড়েছে। এমনিতেই বছরের এই সময়টাতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। ইতিমধ্যেই যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যায় গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে ৩০০-এর বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এডিস মশা নিধনে তরিৎ পদক্ষেপ না নিলে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু গত বছরের তুলনায় আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হতে পারে বলে ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ছয়গুণ। গতবছর এই সময়ে রোগী ছিল ৫০ জন, সেখানে এখন পর্যন্ত রোগী হয়েছে ৩০০ জন। মশা নিধনের কোন উদ্যোগ না থাকায় পরিবেশে এডিসের ঘনত্বও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।

বাংলাদেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য করোনা একটি ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়। তারা তখন পার্সোনাল প্রকেটশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই দাবি করেন এবং জানান পিপিই ছাড়া চিকিৎসা আসলেই অসম্ভব। এরপরই বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সর্দি-জ্বরের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। এখন ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে না ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো বড় হাসপাতালেও। হবিগঞ্জের পেয়ারা বেগম ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ঢামেকে। ভর্তি হয়ে হাসপাতালে একটি ক্যামোও দিয়েছেন। সম্প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, করোনার জন্য এখন তাকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই তিনি বাড়ি চলে গেছেন। তার এক স্বজন জানিয়েছেন, তিনি এখন বিনা চিকিৎসায় মরণব্যাধি ক্যানসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, তারা এমন কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। রোগীরা অবশ্যই চিকিৎসা পাবেন। রোগীদের একটু ধৈর্য ধরার আহবান জানানা তিনি। দেশে নামীদামী বেসরকারি হাসপাতালগুলো সীমিত আকারে তাদের চিকিৎসা চালাচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানি নজিরবিহীন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনার পাশাপাশি এই স্বাস্থ্যসেবার সংকটের বিষয়টিতেও অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় করোনা ছাড়াই কেবল চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারেন অনেক মানুষ। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। পুরান ঢাকার সেকশেন নিয়মিত শিশু রোগীকে দেখান মা জেসমিন। সম্প্রতি ওখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের খোঁজ নিলে তাকে কর্তব্যরতরা জানান, করোনার কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বসেন না। তাই রোগী দেখাতে পারছেন না এই অভিভাবক। এদিকে ঢাকার বাইরেও সংকট। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন কিংবা মারা গেছেন এমন খবরে পুরো হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। গত কয়েকদিনে চিকিৎসার অভাবেই মারা গেছেন অনেক রোগী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে গত ৮ই  মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ৯২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস)-এর এক গবেষণার প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা আক্রান্ত হননি এমন ৩৩ জন রোগী চিকিৎসকদের অবহেলায় মারা গেছেন। বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে আটটি এবং পরিবার পরিত্যক্ত হয়েছেন ২৩ জন। দু’জন সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার শঙ্কায় আত্মহত্যা করেছেন।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৮ই মার্চ থেকে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৯৮জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৬৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন  ৩ হাজার ৮৮২ জন।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status