মত-মতান্তর

প্রেস ক্লাব, কবে যেতে পারব?

কাজল ঘোষ

১ মে ২০২০, শুক্রবার, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

ঊনিশশো একাত্তর। পঁচিশে মার্চের কালো রাত। অকষ্মাৎ ক্র্যাকডাউন। মুহূর্মুহূ শেল ছুঁড়ছে পাকবাহিনী। প্রেসক্লাবের পুরোনো লাল দালানের দুতলায় বসা ফয়েজ আহমদ। রাতে মাথার উপর দিয়ে শেল চলে গেছে বেশ কবার। ভাগ্যগুনে বেঁচে যান তিনি। হামলা হতে পারে এমনটা জানাই ছিল। শোনা যায়, নানা আশঙ্কার কথা শুনেও তিনি ক্লাবেই ছিলেন। বলেছেন, ক্লাব ছেড়ে কোথায় যাব? বলছি, মধ্যরাতের অশ্বারোহী খ্যাত প্রয়াত ফয়েজ আহমদের কথা। সামরিক, বেসামরিক কোন তরফের শাসকের রক্তচক্ষুই যাকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে আটকাতে পারেনি, ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করতে পারেনি।
অপর সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক প্রয়াত এবিএম মূসা। যিনি নানা দৈব দুর্বিপাক আর কারফিউতেও ক্লাবে ছুটে যেতেন। অসুস্থতা নিয়েও আড্ডা দিতেন। বলতেন, প্রেসক্লাব আমার দ্বিতীয় বাড়ি। হাসপাতালে শেষ শয্যা নেয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকালে এখানে আড্ডা দেয়া ছিল যার অভ্যাস। প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারও প্রতিদিন অন্তত একবার ছুটে যেতেন ক্লাবে। বৈঠকী আড্ডায় গা ভাসাতেন। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় খ্যাত কবি হেলাল হাফিজের দিনরাত কাটে ক্লাবেই।

সিনিয়র কি জুনিয়র, ক্লাব সদস্যদের এমন অনেকে আছেন যাদের দিন শুরু হয় ক্লাবের নাস্তা দিয়ে। দিনান্তে আড্ডা শেষ হয় রাতের খাবারে। কিন্তু করোনা ভাইরাস আতঙ্ক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। আড্ডার গোলটেবিলগুলো শূন্যতায় হাহাকার করছে। বেলকনি আর লনের চেয়ার টেবিল ধুলোর প্রলেপে ঢেকে যাচ্ছে। তিন অক্ষরের ‘করোনা’ প্রেসক্লাবের ৬৬ বছরের রেকর্ডকে গরমিল করে দিয়েছে। ‘প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ’ শব্দবন্ধে আটকে দিয়েছে ক্লাবকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যা হয়নি এবার তাই হয়েছে। প্রেসক্লাবের সূচনা ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর। ২০২০ সালের এপ্রিলে ৬৬ অতিক্রম করছে ক্লাব। এই দীর্ঘ সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও প্রেসক্লাবের দরোজা বন্ধ হয়নি। অন্তত রেকর্ড তাই বলে। এমনকি ঈদ ছুটিতেও প্রেসক্লাবে আড্ডা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। অকষ্মাৎ এক ঘোষণায় গত ২১ মার্চ থেকে বন্ধ আছে প্রেসক্লাব। জাতীয় ছুটির সঙ্গে মিল রেখে ক্লাবের বন্ধ থাকার নোটিশও বর্ধিত হচ্ছে দফায় দফায়। সবশেষ বুধবার জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামী ৩০মে পর্যন্ত ক্লাব বন্ধ রাখার।
এই যখন অবস্থা। তখন নিয়মিত ক্লাবে যান এমন অনেকেই আছেন মনঃকষ্টে। একেবারে বন্ধ না রেখে কেউ কেউ সীমিত আকারে ক্লাবের মিডিয়া কক্ষ চালু রাখারও কথা বলছেন। অনেকেই বলছেন, লকডাউনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রেসক্লাবের বন্ধ। কিন্তু আর কত অপেক্ষা? প্রেসক্লাবের বন্ধ দুয়ার খুলবে কবে?
একাধিকবার প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন, আছেন এমন চার সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেছি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। বিস্তারিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:


দ্বিতীয় বাড়ি গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি: রিয়াজ উদ্দিন আহমদ
প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসার মতোই প্রেসক্লাবকে দ্বিতীয় বাড়ি মনে করেন সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমদ। চার দফায় টানা আট বছর প্রেসক্লাব সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। লকডাউনে প্রেসক্লাব বন্ধ থাকা এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেসক্লাব বন্ধ ছিল না। যদিও সে সময়টা ছিল যুদ্ধকালীন। আমরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে তখন প্রেসক্লাব যাওয়াকে একটা যুদ্ধ বলেই মনে করেছি।
কিন্তু এবারের যুদ্ধ রোগের বিরুদ্ধে। এবার মেডিক্যাল কমপালশন আর জীবন রক্ষার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রক্সি দেয়ার কোন উপায় নেই। সকালে পার্কে হাঁটা বন্ধ, কারও সঙ্গে গল্প করা বন্ধ। করোনা আমাদের সামাজিক জীবনকে একেবারে পঙ্গু করে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার দ্বিতীয় বাড়ি প্রেসক্লাব কিন্তু আমি তো প্রথম বাড়িতেই আটকে গেছি। দ্বিতীয় বাড়ি গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারতাম। যদিও সেখানে যাওয়া এখন নিষিদ্ধ।

খারাপ লাগছে, আড্ডা দিতে পারছি না: শফিকুর রহমান
অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে আছি; প্রেসক্লাবে আড্ডা দিতে না পেরে খারাপ লাগছে উল্লেখ করে সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেসক্লাব প্রথমদিকে দু একদিন বন্ধ থাকলেও পরে খোলা ছিল। সেটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা বিশেষত জীবন রক্ষার প্রয়োজনে ক্লাব বন্ধ রাখতেই হবে। আমরা কার বিরুদ্ধে লড়ছি এটাই এখনও বুঝতে পারছি না। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত করোনা নির্মূলে প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। একটাই সমাধান আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন। আর ঘরে থাকা, বাইরে না যাওয়া, বার বার হাত ধোঁয়া। প্রেসক্লাব বা জনসমাগম হয় এমন কোনও এলাকায় গেলে তার সংক্রমণ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় প্রেসক্লাব আরও দু মাস বন্ধ রাখা যেতে পারে। কারণ, আমরা এখনও বুঝতেই পারছি না কিসের সঙ্গে লড়ছি।


সীমিত আকারে মিডিয়া কক্ষ খোলা রাখা যেত: শওকত মাহমুদ
স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সীমিত আকারে মিডিয়া কক্ষ খোলা রাখার পরামর্শ দিলেন সিনিয়র সাংবাদিক শওকত মাহমুদ। যিনি প্রেসক্লাবে দু দফায় সাধারণ সম্পাদক ও দু দফায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় এক দশকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় তিনি মনে করেন, সাংবাদিকরা ঘরবন্দি থাকে না। কিন্তু করোনার প্রভাবে প্রেসক্লাব বন্ধ থাকায় কষ্টে আছি। কারণ, সেখানে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হতো, মত বিনিময় হতো, পারষ্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় হতো। বলা যায়, একধরণের মিতষ্ক্রিয়া হতো। এখন তা একেবারেই বন্ধ। তাছাড়া সহকর্মীদের কেউ মারা গেলে কোথায় জানাযা হবে এটা ভেবেও এখন অংশ নিতে পারছি না, তাই খুব খারাপ লাগে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিতভাবে মিডিয়া কক্ষ খোলা রাখা যেত। যেহেতু বেশিরভাগ পত্রিকা অফিস খোলা আছে। আমাদের বেশকিছু সাংবাদিক মিডিয়া কক্ষে বসে তাদের জরুরি রিপোর্ট ফাইল করে অফিসে পাঠায়। এখন তারা তা করতে পারছে না বলে নানা সমস্যা হচ্ছে। সেজন্য মিডিয়া কক্ষ সীমিত আকারে খোলা রাখলে ভাল হতো।


মন হাহাকার করে, শূন্যতা অনুভব করি: সাইফুল আলম
দেশের কোনও সঙ্কটময় মুহূর্তেও একদিনের জন্য প্রেসক্লাব বন্ধ থাকেনি। প্রেসক্লাব আমাদের সেকেন্ড হোম। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবসরে, ছুটির দিনে প্রেসক্লাবে আড্ডা দিয়ে কাটাই। এমনকি ঈদের দিনও প্রেসক্লাব বন্ধ থাকে নি উল্লেখ করে প্রেসক্লাব সভাপতি ও যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, করোনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রেসক্লাব বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। কোনও কাজে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে গেলে মনটা হাহাকার করে উঠে। ভীষণ শূণ্যতা অনুভব করি।  তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সাংবাদিক সমাজকে রক্ষা করতেই প্রেসক্লাব বন্ধ করতে হয়েছে। ক্লাব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন দুঃখজনক, অন্যদিকে সতর্কতার জন্য অন্য কোন বিকল্পও আমাদের কাছে ছিল না।
আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন, নানা ঝুঁকি নিয়েই সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাংবাদিকরাই প্রথম সারির সৈনিক। সাংবাদিকরা ভালো নেই। ইতিমধ্যেই একজন সাংবাদিক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বেশ কজন আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের অন্যান্য শিল্পের মতো সংবাদপত্রও বর্তমান তীব্র সঙ্কটে আছে। বিজ্ঞাপন কমে গেছে, কাগজের সরবরাহ লাইন বন্ধ আছে। কাজেই এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে প্রাতিষ্টানিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status