বিশ্বজমিন

করোনা ভাইরাসের কারণে নির্বাচন পেছাবেন ট্রাম্প? কী ঘটবে সেক্ষেত্রে?

জেমস পিন্ডেন:

৫ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ৮:৫২ পূর্বাহ্ন

দুই সপ্তাহ আগে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলীয় গভর্নর মাইক ডেওয়াইন আদালতের কাছে তার রাজ্যে অনুষ্ঠেয় প্রাইমারি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার আবেদন জানান। তার যুক্তি ছিল, করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মনোনিবেশ করতে হলে নির্বাচন পেছাতে হবে। কিন্তু আদালত সেই যুক্তি মানে নি। নির্বাচনও পেছায় নি। কিন্তু আদালত না পেছালেও, গভর্নর নিজেই স্ব-ক্ষমতাবলে জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির কারণ দেখিয়ে নির্বাচন পেছান।

এ বছর আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এ বছরই প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন। দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এসে সব ওলটপালট করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে গতানুগতিক উপায়ে নির্বাচন আয়োজন করার অর্থ হলো জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলা। ট্রাম্প অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলেন নি।

এমনকি হতে পারে, ট্রাম্প গভর্ণর ডেওয়াইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গোটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই পিছিয়ে দিলেন! প্রেসিডেন্টের কি এই ক্ষমতা আছে? এই প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক। কেননা, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি নিজের ক্ষমতা এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, যা তার ৪০ পূর্বসুরীর কেউই করেন নি। সংবিধান ও সরকারের অন্যান্য শাখা, অর্থাৎ কংগ্রেস, নিজের দল—সব কিছু নিয়েই জুয়া খেলেছেন তিনি। এমনসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা মার্কিন ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তার দ্বারা কি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া খুব অসম্ভব?

ট্রাম্প যত বেয়াড়াই হোন না কেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও খোদ আইনই স্পষ্টভাবে বলছে যে, তিনি নির্বাচন পেছানোর ক্ষমতা রাখেন না। অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচন, এমনকি অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারি আয়োজনের ক্ষেত্রে স্ব স্ব রাজ্য ও স্থানীয় সরকারকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের (প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচন) ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগকে তেমন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক নোয়াহ ফেল্ডম্যান বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনোভাবে নির্বাচন পেছাতে বা বাতিল করতে পারবেন, এমন কোনো সুযোগ নেই। আমি তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছি না। আমি তার বিকল্প বিবেচনা করেই এই কথা বলেছি।’

কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক ও নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ জশুয়া ডগলাস বলেন, মার্কিন সংবিধানে খুব স্পষ্টভাবেই লেখা আছে যে, কংগ্রেস—শুধুমাত্র কংগ্রেসই—পারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঠিক করতে। সংবিধানে বলা আছে, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচক (ইলেক্টর্স) বেছে নেয়ার সময়, কোন তারিখে তারা ভোট দেবেন, তা কংগ্রেস ঠিক করবে।’ উল্লেখ্য যে, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো পর্যায়ে নির্বাহী বিভাগের নামও উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া কেন্দ্রীয় আইনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের দিনই নির্বাচন হতে হবে।

ডগলাস বলেন, ‘এসব নিয়ম এককভাবে পরিবর্তনের কোনো কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের নেই। প্রেসিডেন্ট যদি ‘মার্শাল ল’ জারি করেন, তাতেও তিনি সংবিধান এভাবে পরিবর্তন করতে পারবেন না।’

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক রিক হাসান এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। তিনি জানান, ২০ জানুয়ারির আগে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।

তবে তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট অবশ্য ওই দিন মার্শাল ল’ বা অন্য আদেশ জারির মাধ্যমে মানুষকে নির্বাচনে যেতে দেবেন না।’ কিন্তু সেক্ষেত্রেও নির্বাচন পেছাবে না। নির্বাচনের ফল হয়তো ভিন্ন হবে।

এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, কংগ্রেসই পারে প্রয়োজন মনে করলে এই বছরের পরে কোনো তারিখে নির্বাচন পিছিয়ে নিতে। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের হাতে সময় বেশি নেই।

সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, ইলেক্টোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলী যদি প্রেসিডেন্টকে পুনঃনির্বাচিত না করে, তাহলে তাকে ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে ২০ জানুয়ারি পদত্যাগ করতে হবে। অন্যভাবে বললে, কংগ্রেস যদি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ও, ট্রাম্পের পক্ষে নিজের মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়।

এখন ধরা যাক, ৩রা নভেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারিরও পরে অনুষ্ঠিত হলো। তাহলে কী ঘটবে?

আগেই বলা হয়েছে সেক্ষেত্রে ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে পদত্যাগ করতেই হবে। তাদের পরে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। যদি তা-ই হয়, তাহলে ডেমোক্রেট দলীয় ন্যান্সি পেলোসি হবেন মার্কিন ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সমস্যা হলো, কংগ্রেস সদস্য হিসেবে পেলোসির মেয়াদ ৩রা জানুয়ারি পর্যন্ত। এরই মধ্যে কংগ্রেস নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু জানুয়ারির মধ্যে যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হয়, তাহলে কংগ্রেস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই! সেক্ষেত্রে ন্যান্সি পেলোসি তো বটেই, জানুয়ারি ৩ নাগাদ কংগ্রেসের প্রত্যেক সদস্যের আসনই ফাঁকা হয়ে যাবে!

প্রেসিডেন্ট হওয়ার সারিতে ৪ নম্বরে আছেন সিনেট প্রো টেম্পোর। রীতি অনুযায়ী, সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রিপাবলিকানদের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সিনেটর হিসেবে এই পদে আছেন আইওয়া থেকে নির্বাচিত চাক গ্র্যাসলি। কিন্তু গ্র্যাসলিও প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না।

কারণ, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই সিনেটের ১০০ আসনের ৩৫টিরই নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হয়, তাদের নির্বাচনও হবে না। সেক্ষেত্রে ২০ জানুয়ারি নাগাদ এই ৩৫টি আসন ফাঁকা থাকবে। এই ৩৫টি আসনের ২৩টিতেই বর্তমানে আছেন রিপাবলিকান সদস্য। ফলে এই আসনগুলো ফাঁকা হয়ে গেলে রিপাবলিকানরা হয়ে পড়বেন সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হবে ডেমোক্রেটরা। সে অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সবচেয়ে প্রবীণ সিনেটর হিসেবে সিনেট প্রো টেম্পোর হবেন ভারমন্টের সিনেটর প্যাট লিহি। সেই হিসাবে ৮০ বছর বয়সী এই সিনেটরই জন এফ কেনেডির পর হবেন নিউ ইংল্যান্ড থেকে আসা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু তারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ! কেননা, তত্ত্বগতভাবে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হলেও, অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনসভা আইনি মারপ্যাঁচের মাধ্যমে ইলেক্টোরাল কলেজে নিজ নিজ ইলেক্টর বা নির্বাচক প্রেরণ করতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে, তত্ত্বগতভাবে, সরাসরি জনগণের ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে। প্রত্যেক রাজ্যে ২টি করে সিনেট আসন আছে। আর আয়তনভেদে বিভিন্ন সংখ্যক প্রতিনিধি পরিষদের আসন আছে। প্রত্যেক রাজ্যে যত সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ আছে, ঠিক ততটিই তাদের ইলেক্টর সংখ্যা।

সাধারণত, জনগণের ভোটেরই প্রতিনিধিত্ব করেন ইলেক্টোরাল কলেজ। কিন্তু নির্বাচন না হলে সেই সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভাগুলো এক্ষেত্রে ইলেক্টর পাঠাতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হলো বর্তমানে ৪টি বড় ‘সুইং’ অঙ্গরাজ্যের আইনসভা রিপাবলিকান অধ্যুষিত হলেও, তাদের গভর্নর আবার ডেমোক্রেট। এই ৪ বৃহৎ রাজ্য হলো মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভ্যানিয়া ও উইসকনসিন। ফলে এই ৪টি অঙ্গরাজ্য কীভাবে ও কাকে তাদের ইলেক্টর ঠিক করবে, তা স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।

 

ঐতিহাসিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন পেছানোর ঘটনা খুবই বিরল। কিন্তু তাই বলে নজিরবিহীন নয়। এ বছরই করোনা ভাইরাসের কারণে ওহাইওর পাশাপাশি ১১টি অঙ্গরাজ্য তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রাইমারি পিছিয়েছে।

২০০১ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের প্রাইমারি হওয়ার কথা ছিল ১১ই সেপ্টেম্বর। ঠিক সেদিনই শহরটিতে ঘটলো ৯/১১-এর কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামলা। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন বাতিল করা হলো ও দুই সপ্তাহ পরে নতুন তারিখ ঠিক করা হলো।

কিন্তু এগুলো সবই রাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচন। গত মাসে নির্দলীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পেছানোর প্রশ্নে গবেষণা শুরু করে। সংস্থাটি ইতিহাস ঘেঁটে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পেছানোর মাত্র একটি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। সেটি হলো ২০১৮ সালে নর্দার্ন ম্যারিয়ানা আইল্যান্ড তাদের সাধারণ নির্বাচন টাইফুনের কারণে পিছিয়ে দিয়েছিল।

ইতিহাসে আবার এ-ও আছে যে, ১৯১৮ সালে যখন স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির কারণে কাতারে কাতারে মানুষ মরছিল আমেরিকায়, তবুও মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে না, এমন সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

(জেমস পিন্ডেন একজন মার্কিন সাংবাদিক। তার এই নিবন্ধ বোস্টন গ্লোব পত্রিকা থেকে নেয়া হয়েছে)

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status