বিশ্বজমিন

করোনা ভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে? (পর্ব-১)

সাইমন মাইর

৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ৬:১৯ পূর্বাহ্ন

আগামী ছয় মাস, এক বছর, দশ বছর পর আমরা কোথায় থাকবো? আমি রাত জেগে ভাবি, আমার প্রিয়জনদের জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। আমার ঝুঁকিতে থাকা বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। আমি চিন্তা করি, আমার চাকরির কী হবে, যদিও আমি অনেকের চেয়েই ভাগ্যবান। আমি অসুস্থতাকালীন ছুটি পাই। ঘরে বসে কাজ করতে পারি। আমি এসব লিখছি বৃটেন থেকে। এখানে আমার অনেক আত্মনির্ভর বন্ধু আছে, যারা আগামী মাসগুলোয় অর্থ উপার্জন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এমন অনেকে আছে যারা ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছে। যে চুক্তির আওতায় আমার ৮০ শতাংশ বেতন হয়, সেটির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাবে। করোনা ভাইরাস অর্থনীতির উপর বাজেভাবে আঘাত হানছে। আমার যখন চাকরির দরকার পড়বে, তখন কেউ কী লোক নিয়োগ দেবে?
এই মুহূর্তে বেশকিছু সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রয়েছে। সবগুলোই বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব সামলাতে সরকার ও সমাজের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। আশা করা যায় যে, আমরা এই সংকট ব্যবহার করে নতুন করে গড়তে, আরো ভালো ও মানবিক কিছু সৃষ্টি করতে পারবো। কিন্তু আমরা বর্তমানের চেয়ে আরো খারাপ দিকেও গড়াতে পারি।
আমি মনে করি, আমরা অন্যান্য সংকটের অর্থশাস্ত্র খেয়াল করলে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে পারবো। ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তাও বুঝতে পারবো। আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে জোর দিয়ে আমি গবেষণা করেছি: বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন, মজুরি ও উৎপাদন। অর্থনৈতিক গতিবিদ্যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং শ্রমিকদের মধ্যে নিম্ন পর্যায়ের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো প্রতিবন্ধকতা কীভাবে সামাল দেয় সেদিকে জোর দিয়েছি। আমার মতে, সামাজিকভাবে ন্যায্য ও পরিবেশগতভাবে সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের জন্য আমাদের একেবারে ভিন্ন ধরণের অর্থনীতির প্রয়োজন। করোনা ভাইরাস সংকটে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকারের প্রতিক্রিয়া কেবল সামাজিক ও পরিবেশগত সংকটের বিভিন্ন প্রক্রিয়া জোরদার করেছে: বিকল্প বাদ দিয়ে একধরণের মূল্যায়ন অগ্রাধিকার পেয়েছে। এই প্রক্রিয়া কভিড-১৯ মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ভাইরাসের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া বিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কীভাবে গড়ে উঠা উচিৎ?
অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আমাদের কাছে চারটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রয়েছে: বর্বরতায় নেমে আসা, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বৃদ্ধি, কট্টর সমাজতন্ত্র এবং পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে বড় ধরণের সমাজ গড়ে তোলা। এগুলোর যেকোনো একটাই আমাদের ভবিষ্যৎ হতে পারে।
স্বল্পমাত্রার পরিবর্তন যথেষ্ট নয়
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো করোনা ভাইরাসও আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোরই একটি আংশিক সমস্যা। যদিও উভয় সংকটই আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশগত বা প্রাকৃতিক সমস্যা দেখায়, কিন্তু দুটোই সামাজিক কারণে ঘটেছে।
হ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা এ সমস্যা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, এই গ্যাসগুলো নির্গমণের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক কারণ। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। মূল কারণ ভাইরাস হলেও, এটি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের মানবিক আচরণ ও এর বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে।
করোনা ভাইরাস ও জলবায়ু পরিবর্তন সামাল দেয়া সহজ হবে যদি, অনাবশ্যক অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, যদি উৎপাদন কমে যায়, তাহলে কম জ্বালানি খরচ হবে, কম গ্যাস নির্গমণ হবে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দ্রুত বদলাচ্ছে। কিন্তু মূল তথ্য একই আছে। মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয় ও সংক্রমিত হয়। এ ধরণের সংমিশ্রন বা জমায়েত কমানো গেলে সংক্রমণ কমবে।
আমরা উহানে দেখেছি যে, সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকরী। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে এই পদক্ষেপ আগেভাগে কেন নেয়া হয়নি, অর্থশাস্ত্র আমাদের সেটি বুঝতে সাহায্য করবে।
ভঙ্গুর অর্থনীতি
লকডাউন বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর চাপ ফেলছে। আমরা গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন। অনেক নেতাই লকডাউন হালকা করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো। অন্যদিকে বৃটেনে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছিলেন, ১২ সপ্তাহেই ভাইরাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারবে দেশটি। এর চারদিন পরই দেশটিতে লকডাউন জারি করা হয়।
ব্যবসার অস্তিত্বই লাভ করার জন্য। উৎপাদন না হলে, বিক্রি হবে না। মানে, লাভ হবে না। যার মানে, কর্মী নিয়োগ হবে না। ব্যবসাগুলো স্বল্প সময়ের জন্য অনাবশ্যক কর্মীদের ধরে রাখে, এই আশায় যে, পরিস্থিতি ফিরে আসলে যাতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি বেশি খারাপের দিকে এগুলে তারা আর কর্মীদের ধরে রাখে না। মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে থাকে। ফলে তারা পণ্য কেনেও কম। আর পুরো চক্র নতুন করে শুরু হয়। আমরা এগুতে থাকি অর্থনৈতিক মন্দার দিকে।
স্বাভাবিক সংকটের ক্ষেত্রে এর সমাধান সহজ। সরকার খরচ করে, যতদিন না মানুষজন ফের কেনা শুরু করে ও কাজ ফিরে পায়। কিন্তু বর্তমানে এ কৌশল কাজে দেবে না। অন্তত, তাৎক্ষণিকভাবে না। লকডাউনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনগনকে কাজে যাওয়া থেকে বিরত রাখা।
অর্থনীতিবিদ জেমস মিডওয়ে লিখেছেন, কভিড-১৯ মোকাবিলায় নেয়া পদক্ষেপগুলো যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো নয়। আমাদের দরকার যুদ্ধকালীন-বিরোধী পদক্ষেপ। ভবিষ্যতের মহামারী সামাল দিতে হলে আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা দরকার যার আওতায় উৎপাদন কমানো যাবে কিন্তু মানুষ কাজ হারাবে না।
আমাদের যেটা দরকার সেটা হচ্ছে ভিন্ন অর্থনৈতিক মানসিকতা। আমরা মূলত অর্থনীতিকে বিবেচনা করি ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনার বিচারে। কিন্তু অর্থনীতি এমনই হতে হবে তা নয়। একেবারে কেন্দ্রে, অর্থনীতি হচ্ছে, আমাদের সম্পদ ও বাঁচার জন্য সেগুলোর ব্যবহার। এরকম দৃষ্টিতে দেখলে, আমরা বেঁচে থাকার জন্য নতুন সুযোগ দেখতে পারি, যার আওতায় কম উৎপাদন করেও দুর্দশা এড়ানো যায়। তো কম উৎপাদন করেও মানুষকে কীভাবে চাকরিতে রাখা যায়?
সপ্তাহে কাজের সময় কমানো বা ধীরে কাজ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এগুলোর কোনোটাই করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রয়োগযোগ্য নয়। কিন্তু মূল প্রস্তাবনা একই। মানুষের বেতনের উপর বেঁচে থাকার নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
(দ্য কনভার্সেশনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। আগামীকাল প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে। মূল প্রতিবেদনটির লেখক ইউনিভার্সিটি অব সারে-এর সেন্টার ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সাসটেইনেবল প্রসপারেটির পরিবেশগত অর্থনীতির রিসার্চ ফেলো)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status