করোনা আপডেট

করোনা ভাইরাস ঠেকাতে ফোন নজরদারি: সাংবাদিকদের যা জানা উচিত

মানবজমিন ডেস্ক

২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার করোনা ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে মোবাইল ফোনে নজরদারি করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। রয়টার্স জানিয়েছে ইতালি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় ফোন ব্যবহারকারীদের অবস্থানের তথ্য জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ফোন কোম্পানিগুলো। তবে এই তথ্য একত্রিত ও নাম-পরিচয় ছাড়া দেয়া হবে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ব্যক্তিপর্যায়ে সেলফোনের অবস্থান মনিটর করছে। ইসরাইলে এই সপ্তাহে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বাহিনীকে অনুমতি দিয়েছে লাখ লাখ ব্যবহারকারীর পুরোনো তথ্য ব্যবহার করতে। এছাড়া ইরান, পোল্যান্ড ও ভারতে সরকার অ্যাপ তৈরি করছে যেন কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করা যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। কিন্তু সাংবাদিকরাও জানেন যে, তাদের কাজের প্রতি সরকার ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর নজরদারির কারণে কী কী ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক বিল মারজাক মোবাইল ফোন নজরদারি প্রযুক্তি বিষয়ে একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার যেসব নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে, সে কারণে সাংবাদিকরা কী কী ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, তা নিয়ে মারজাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বখ্যাত সিটিজেন ল্যাবের ফেলো হিসেবেও কাজ করছেন মারজাক। তিনি ইসরাইলি গুপ্তচরবৃত্তির সফটওয়্যার পেগাসাসের কথা প্রথম চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেছেন যে, এই সংকটকালীন সময়ে যেসব নজরদারিমুলক ক্ষমতা ও প্রযুক্তি বের হবে, তা প্রত্যাহার করা অত্যন্ত কঠিন হবে। এই প্রযুক্তি পরবর্তীতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।
তার এই সাক্ষাৎকার মানবজমিনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে আছি যে, বহু সরকারই বলছে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মোবাইল ফোন নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। আপনি কি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন?

উত্তর: যখনই মানুষের তথ্য ও উপাত্ত বেশি বেশি করে সংগ্রহের প্রস্তাব নিয়ে তোড়জোড় করা হয়, ঠিক তখনই এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, এই সময়েই খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত যাচাইবাছাই ছাড়াই অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এক ধরণের জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, যা করার এখনই করতে হবে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা তখন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
মোবাইল ফোনের অবস্থান বিষয় যে সকল ডেটা দেয়া হবে, সেখানে কারও নাম, ঠিকানা দেয়া না হলেও, রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে দেখা যাবে কে বাড়িতে, কে কর্মস্থলে, আর কে ট্রেনে। ফলে কোনো সাংবাদিক যদি তার সূত্রের সঙ্গে দেখা করেন, তা-ও বোঝা সম্ভব।

প্রশ্ন: এই সংকটের সময় মোবাইল ফোনের নজরদারি বৃদ্ধির জন্য অনেক প্রস্তাবনাই আমরা দেখেছি। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

উত্তর: একদিকে আমরা দেখি ইসরাইলের মতো দেশে, যেখানে কর্তৃপক্ষ মানুষকে বলছে, আমরা আপনাদের মেটাডেটা (যে ডেটা অন্যান্য ডেটা সম্পর্কে তথ্য দেয়) ২০০২ সাল থেকে সংগ্রহ করছি। আমরা কখনই আপনাদের তা বলিনি। এখন আমরা সেই ডেটা জনস্বাস্থ্যের কাজে ব্যবহার করবো।
আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলা হচ্ছে মানুষের ফোনে। কিছু অ্যাপ মানুষের লোকেশন সনাক্ত করে, কিছু অ্যাপ দাবি করে যে তারা করে না।

যেমন, সিঙ্গাপুরে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই অ্যাপ শুধু মানুষের ‘প্রক্সিমিটি’ (নৈকট্য) সনাক্ত করে। তারা এক্ষেত্রে ব্লুটুথ ব্যবহার করে। এখন কোনো ব্যবহারকারী যদি ভাইরাস আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রক্সিমিটি ডেটা ব্যবহার করে দেখতে পারবে যে কারা কারা তার মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েছেন। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ বা তথ্যভা-ার থাকার প্রয়োজন হয় না। তবে এসব ডেটাও সমস্যার কারণ হতে পারে। এসব ডেটা যদি ওই ব্যক্তির ফোনেই থাকে, আর সেই ফোন যদি কর্তৃপক্ষ জব্দ করে, তাহলে সব বের হয়ে যাবে। আপনি হয়তো এমন পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে পারেন যেখানে হয়তো কর্তৃপক্ষ বলছে, এই লোক সাংবাদিক কিংবা অধিকারকর্মী। দেখি এই লোক কার কার সাথে দেখা করে। তার ফোন জব্দ করলেই বোঝা যাবে। ফলে প্রক্সিমিটি ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে ক্ষুণè হতে পারে। তবে এই ডেটা যদি ব্যবহারকারীর ফোনেই সংরক্ষিত হয়, তাহলে বড় আকারে অপব্যবহারের ঝুঁকি কম।


প্রশ্ন: এ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে যে, সরকার কীভাবে মোবাইল ফোনের এসব তথ্য পাচ্ছে। এ বিষয়টি আসলে কীভাবে কাজ করে?

উত্তর: প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যদি আপনি চিন্তা করেন, তাহলে সরকারের কেবল যা করতে হয় তা হলো, মোবাইল ফোন কোম্পানির কাছে গিয়ে বলা যে, ‘আমাদের এই এই ডেটা প্রয়োজন। আপনারা কি আমাদেরকে দেবেন?’ এরপর দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরণের বোঝাপড়া হয়। তারই আওতায় কোম্পানি থেকে সেসব তথ্য সরকারি ডেটাবেজে দেয়া হয়। কিংবা ওই তথ্য ফোন কোম্পানি নিজেই সংগ্রহ করে রাখে। সরকার সময়ে সময়ে তা চেয়ে নেয়।

কিন্তু মূল কথা হলো, ফোন কোম্পানিগুলো এ ধরণের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে ও করে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এমনও ঘটনা দেখেছি যে, অনেকে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে মানুষের অবস্থানের তথ্য কিনে নিচ্ছে। আমি মনে করি মানসিকভাবে এটা ধরে নেয়া উচিত যে, ফোন কোম্পানিগুলো এসব ডেটা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। প্রয়োজনে সেই ডেটা পরে কাউকে দেয় বা বিক্রিও করে।

প্রশ্ন: আমরা দেখছি যে কিছু বেসরকারী কোম্পানি এসে বলছে তারা এমন সিস্টেম তৈরি করতে পারবে, যেখানে মানুষের অবস্থানের তথ্য জোগাড় করে রাখা সম্ভব হবে। যার ফলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ হবে।

উত্তর: কিছু প্রতিবেদন এসেছে যে, এনএসও গ্রুপ (কুখ্যাত নজরদারির সফটওয়্যার পেগাসাস-এর ইসরাইলি নির্মাতা) সম্ভবত নতুন সিস্টেম তৈরির কথা ভাবছে। সীমিত তথ্যের কারণে জানা সম্ভব হয়নি যে, এটি কীভাবে কাজ করবে। কিন্তু আপনি ধরে নিতে পারেন যে, এখানে এমন পরিস্থিতি হবে যে, কেউ আক্রান্ত হলে, তার নম্বর নেয়া হবে, এরপর এনএসও গ্রুপ সেই নম্বরের অবস্থান শনাক্তের কাজ শুরু হবে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ ও ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্যও এর সঙ্গে যোগ করা হবে। যারা ওই আক্রান্ত ব্যক্তির সং¯পর্শে এসেছিলেন, তাদেরকে নোটিফিকেশন দিয়ে জানিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু আমরা তেমন কিছু জানি না। এনএসও এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়নি।

প্রশ্ন: বেসরকারী নজরদারি কোম্পানিগুলোকে তো মানুষের মানবাধিকার বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার খুব একটা তোয়াক্কা করতে দেখা যায়নি। গত বছর বাকস্বাধীনতা বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি এ ধরণের প্রযুক্তির বিক্রির ওপর বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ দাবি করেছিলেন। একই কোম্পানিগুলো যে এখন সামনে এগিয়ে আসছে, এ নিয়ে কি আপনি উদ্বিগ্ন?

উত্তর: যে জরুরি তাগিদ নিয়ে অনেক সরকার এই করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করছে, আপনি দেখবেন যে, অনেক কর্তৃপক্ষই অপ্রচলিত সমাধানের দিকে ঝুঁকবে। তারা বিদ্যমান নজরদারি কোম্পানির কাছ থেকেই প্রযুক্তিগত সমাধান কেনার চেষ্টা করবে। এই কোম্পানিগুলো গুপ্তচর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে অভ্যস্ত। এদের কেউই ধোয়া তুলসি পাতা না। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো আগেও সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর নজরদারিতে সহায়তা করেছে। এ কারণেই বিষয়টি আমার কাছে উদ্বেগজনক। আমি আরেকটি বিষয় নিয়েও উদ্বিগ্ন। এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে সরকার এখন লোকেশন ট্র্যাকিং-এর জন্য নয়া নজরদারিমূলক সিস্টেমের পেছনে অর্থ ঢালবে। কিন্তু এই ভাইরাস যখন নির্মূল হবে, এরপর এই সিস্টেমের কী হবে? এই সিস্টেম কীভাবে ব্যবহৃত হবে পরবর্তীতে? মানুষের গতিবিধি নজরে রাখতে আপনি যখন কোনো সিস্টেম ক্রয় করেন, সেই সিস্টেম খুব সহজেই কিন্তু বাদ দেয়া হয় না।

প্রশ্ন: এখন বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন সরকার বেশি ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্যরে পেছনে ছুটছে। ফোনকলে আড়িপাততে চাইছে। নজরদারি করতে চাইছে। এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের কী ভাবা উচিত? তাদের কি প্রতিরোধ করা উচিত?

উত্তর: আমি বলবো না যে, আক্রান্তদের খুঁজে বের করার চেষ্টায় বাগড়া দেয়া উচিত। কিন্তু যখন এই সংকট শেষ হবে, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তখন মানুষকে এই প্রযুক্তির কথা ভাবতে হবে।

প্রশ্ন: এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কী করতে পারেন?

উত্তর: আমরা চাইবো যে সাংবাদিকরা এই প্রকল্পগুলোর গভীরে যাক। যদি সরকার বলে যে, আমরা লোকেশন ট্র্যাক করছি, তাহলে সাংবাদিকদের উচিত এটি খুঁজে বের করা যে, সরকার আসলে কী করছে। কোন কোম্পানি থেকে সরকার এই যন্ত্রপাতি কিনেছে। সংগৃহীত ডেটা কারা দেখতে পারে।

প্রশ্ন: আমরা কি এখন ফোন নজরদারির ক্ষেত্রে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি?

উত্তর: এখনও বলার সময় আসেনি। এ কারণেই আমি এ নিয়ে চিন্তা করছি। সরকার এমন সব যন্ত্রপাতি চায় যা দিয়ে তাদের কর্তৃত্ববাদ আরও প্রখর করা যায়। কিছু শাসক আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ চায়। জনগণের দৈনন্দিন জীবন স¤পর্কে আরও তথ্য চায়। করোনা ভাইরাস হলো ‘ফেক নিউজ’ বা সাইবার নিরাপত্তা বা সন্ত্রাসবাদের মতো ইস্যুর মতো, যেগুলো অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। যদি সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়, তাহলে উপসংহার হচ্ছে যে, সরকার জানতে পারবে প্রত্যেক মানুষ যেকোনো সময়ে কোথায় অবস্থান করছে। গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটেও আমরা ক্রমেই আরও শুনতে পাবো যে, এসব ট্র্যাকিং পদ্ধতি বেশি করে বাস্তবায়ন করা উচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status