শেষের পাতা

গণস্বাস্থ্যের ২০০ টাকা মূল্যের করোনা কিট কতটা কার্যকর?

মানবজমিন ডেস্ক

২০২০-০৩-২৬

সম্প্রতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মাত্র ৩ ডলার বা ২০০ টাকা মূল্যের করোনা ভাইরাস টেস্ট কিট তৈরি করেছেন। তারা বলছেন, মাত্র ১৫ মিনিটেই এই কিটের মাধ্যমে কারও শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কিনা, তা জানা যাবে। ইতিমধ্যেই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) এই কিট উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। গত সপ্তাহেই একটি জাতীয় দৈনিকে এসেছে যে, দেশে মাত্র ১৭৩২টি টেস্টিং কিট আছে, যা ১৮ কোটি মানুষের দেশে একেবারেই অপ্রতুল। এই অবস্থায় স্বল্পমূল্যের এসব কিট কতটা কার্যকর, তা নিয়ে আল জাজিরায় প্রতিবেদন করেছেন ফয়সাল মাহমুদ।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে এই কিট তৈরি করেছে গণস্বাস্থ্য ও আরএনএ বায়োটেক লিমিটেড। এই ধরনের কিট চীনেও তৈরি হয়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশে যখন এই রোগের উপদ্রব দেখা দেয়, তখন জানুয়ারিতে এই ধরনের স্বল্প মূল্যের কিট প্রস্তুত করা হয়।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে চীনা ওই কিট আমদানির জরুরি অনুমতি দিয়েছিল। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই কিট মূলত করোনা ভাইরাস শনাক্ত করে না। তবে করোনা ভাইরাস শরীরে উপস্থিত হলে শ্বেত রক্ত কণিকা কিছু অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে। ওই অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব খুঁজে পেলে ধরে নেয়া হয় যে, রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাসও আছে। করোনা ভাইরাস না থাকলে, তার অ্যান্টিবডি শরীরে প্রস্তুত হয় না। কিন্তু এই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগে। এ কারণে এই কিট দিয়ে পরীক্ষা করা হলে কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে ভুল সময়ে টেস্ট করা হলে, রোগীর শরীরে ভাইরাস থাকলেও, অ্যান্টিবডি প্রস্তুত না হওয়ায়, তা কিটে ধরা পড়বে না। আবার, কারও শরীরে হয়তো করোনা ভাইরাস ছিল, কিন্তু তিনি সেরে উঠেছেন, এমন ব্যক্তিদের শরীরেও অ্যান্টিবডি থাকবে। কিন্তু কিটে যেহেতু অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে, সেহেতু বলা হবে যে, ভাইরাসও আছে।
করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এখন যেই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা হলো আরটি-পিসিআর। এই পদ্ধতিতে সরাসরি ভাইরাসের উপস্থিতি বের করা হয়, অ্যান্টিবডি নয়। এই কারণে এই পদ্ধতিতে ভুল হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। কিন্তু সমস্যা হলো, এই পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল।
গণস্বাস্থ্যের কিট প্রস্তুতকারী বিজ্ঞানী দলের প্রধান ডা. বিজন কুমার শীল বলেন, তাদের এই পরীক্ষাকে বলা হয় ডট ব্লট টেস্ট। কোনো ভাইরাস শরীরে আসলেই, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। ডা. বিজন কুমার বলছেন, তাদের উদ্ভাবিত কিট রক্তে এই অ্যান্টিবডি খুঁজবে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘করোনা ভাইরাস বা যে কোনো ধরনের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে নাক, মুখ বা চোখ দিয়ে। এরপর গলার রক্ত কণিকার সঙ্গে মিশে যায়, যারা এক ধরনের প্রোটিন উৎপন্ন করে।’ তিনি বলেন, ভাইরাসের বহিঃস্তর প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এই বহিঃস্তরেই থাকবে ওই ভাইরাসের ডিএনএ অথবা আরএনএ। এই আরএনএ-তে ওই ভাইরাস উৎপাদনের নির্দেশিকা থাকে। যেই রক্ত কণিকা আক্রান্ত হয় ভাইরাসে, তারা সেই আরএনএ দেখে, ওই নির্দেশনা মোতাবেক প্রোটিন উৎপন্ন করে। এভাবে কয়েকগুণ নতুন ভাইরাস উৎপন্ন হয়।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু মানুষের কোষে যখন এই সংক্রমণ চলতে থাকে, তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করে রক্তে, যা সেই নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অ্যান্টিবডি হলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রের একটি।’
ডা. শীল বলেন, আমাদের ডট ব্লট পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রক্তে যেই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়, সেটি শনাক্ত করা হয়। রক্তরস, সালিভা ও স্পাটাম নমুনা পরীক্ষা করে কয়েক মিনিটের ভেতরই ফলাফল দেয়া সম্ভব যে রক্তে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি আছে কিনা।
ডা. শীল যখন সিঙ্গাপুরে ছিলেন, তখন ২০০৩ সালে করোনা ভাইরাসের উত্তরসূরি সার্স করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে একই ধরনের একটি কিট তৈরি করেছিলেন। সেই সময় ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে’ সার্স করোনা ভাইরাস শনাক্তে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায়, ওই কিটের প্যাটেন্ট চীন সরকার তার কাছ থেকে কিনে নেয়।
তিনি বলেন, ‘এই কিটের সবচেয়ে ভালো দিক হলো যে, এটি বানানো সস্তা (প্রায় ৩ ডলার বা ২০০ টাকা)। অপরদিকে আরটি-পিসিআর কিট বেশ ব্যয়বহুল।’
ডা. শীলের সহযোগী ডা. মহবুল্লাহ খোন্দকার বলেন, একটি আরটি-পিসিআর কিটের দাম ১২০-১৩০ ডলার বা ১০-১১ হাজার টাকা। এ ছাড়া পিসিআর মেশিন রাখতে একটি বিশেষায়িত বায়োসেফটি পরীক্ষাগার লাগে। প্রত্যেকটি মেশিনের খরচই আছে ১৫০০০ ডলার (১৩ লাখ টাকা) থেকে ৯০ হাজার ডলার (৭৭ লাখ টাকা)।
তিনি জানান, বাংলাদেশে গুটিকয়েক পরীক্ষাগার আছে যেখানে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করার মতো বায়োসেফটি বজায় রাখা সম্ভব। অপরদিকে তাদের কিট দিয়ে পরীক্ষা বাংলাদেশের বেশির ভাগ পরীক্ষাগারেই করা সম্ভব।
ডট-ব্লট কিটের সীমাবদ্ধতা
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর বিগ ডাটা রিসার্চ ইন হেলথের গবেষক ডা. মো. সাজেদুর রহমান বলেন, ডট ব্লট টেস্টের সীমাবদ্ধতাও আছে। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে শরীরের রক্তে যেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা খুঁজে দেখে র‌্যাপিড ডট ব্লট কিট। অপরদিকে আরটি-পিসিআর কিট শ্বাসযন্ত্রের নমুনায় সরাসরি ভাইরাসের খোঁজ করে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু র‌্যাপিড টেস্টে মূলত রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি থাকলেই কার্যকর হয়, সেহেতু পরীক্ষা করার সময়, পূর্ববর্তী সংক্রমণ, ওই ব্যক্তির দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা, অন্যান্য অ্যান্টিজেনের সঙ্গে ক্রস-রিঅ্যাকশন, ইত্যাদি ফ্যাক্টরের কারণে ভুল ফলাফল আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ভুল ফলাফল দুইভাবেই হতে পারে। যেই ব্যক্তির করোনা ভাইরাস আছে, কিন্তু এখনো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি, বা পর্যাপ্ত পরিমাণ হয়নি, তার ক্ষেত্রে ফলাফল নেতিবাচক আসতে পারে। এর দরুন ওই ব্যক্তি হয়তো করোনা ভাইরাস নেই ধরে নিয়ে অসতর্ক থাকতে পারেন। যার ফলে ভাইরাস তার অজ্ঞাতে অন্যদের শরীরে ছড়াতে পারে।
আবার কিছু ব্যক্তির হয়তো করোনা ভাইরাস ছিল, কিন্তু এখন সেরে উঠেছেন, তার শরীরেও অ্যান্টিবডি থাকতে পারে। ফলে পরীক্ষায় তার করোনা ভাইরাস আছে বলে বলা হবে, যদিও তার আসলে নেই। তবে এটি তুলনামূলকভাবে কম বিপজ্জনক।
ডা. সাজেদুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েকটি পরীক্ষাগার এ ধরনের র‌্যাপিড কিট তৈরি করার চেষ্টা করছে। তবে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি, কারণ এই পরীক্ষার যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
তিনি বলেন, এই র‌্যাপিড কিট তবে গণহারে প্রাথমিক স্ক্রিনিং-এ ব্যবহার করা যায়। তবে পরবর্তীতে যাদের নেতিবাচক ফলাফল এসেছে, তাদের পরীক্ষা ফের করাতে হবে।
এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ডা. শীলকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন, ভুল সময়ে ব্যবহৃত হলে র‌্যাপিড ডট ব্লট টেস্টে ভুল ফলাফল আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমাঝে শরীরে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হতে হতে দুই/তিনদিন লেগে যায়। ফলে ভাইরাস প্রবেশ করার পর ৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগে যদি টেস্ট করা হয়, তাহলে ভুল ফলাফল আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আরটি-পিসিআর হলো করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের একমাত্র যথাযথ পরীক্ষা। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি তো স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আরটি-পিসিআর কিটের মারাত্মক অপ্রতুলতা রয়েছে, সেসব দেশে র‌্যাপিড ডট ব্লট টেস্ট আমলে নেয়া উচিত।’
ডা. খোন্দকার বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি। এখানে বেশির ভাগ মানুষের স্বাস্থ্য বীমা নেই। মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে না। এ কারণে আমরা যখন এই কিট বানাই, তখন এই খরচের কথা আমরা মাথায় রেখেছি। চেয়েছি এর দাম যত সস্তা রাখা যায়।
তিনি বলেন, আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি যেন এই কিটের কার্যকারিতা বাড়ানো যায়।
তার ভাষ্য, ‘আপনি বুঝতে পারছেন যে, এটি যুদ্ধ পরিস্থিতির চেয়ে কম নয়। আগামী কয়েক সপ্তাহে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এদের সকলকে আরটি-পিসিআর দিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। কেননা, এই পদ্ধতি শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বেশ সময়সাপেক্ষও বটে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের পরীক্ষায় ১৫ মিনিটের মধ্যে ফলাফল আসে। আর কার্যকারিতা নিয়ে আমি বলবো, এটি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক ফলাফল দেয়।’
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status