বিশ্বজমিন

বিবিসির বিশ্লেষণ

দিল্লি সহিংসতার সঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার মিল!

মানবজমিন ডেস্ক

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৮:২৬ পূর্বাহ্ন

দিল্লির সহিংসতার শুরু ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে। রোববার ছোট পরিসরে সিএএ বিরোধীদের সঙ্গে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। খুব দ্রুত তা পুরোদমে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় দাঙ্গায় রুপ নেয়। দিল্লির ঘনবসতি এলাকাগুলোয় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে দাঙ্গা। সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা দলে দলে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ তা দেখেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা হয়েছে। কোথাও কোথাও এসব হামলায় পুলিশ সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। দায়িত্বরত সাংবাদিকদের উপরেও হামলা হয়েছে। অনেককে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া হয়েছে, তারা কোন ধর্মের তা জিজ্ঞেস করা হয়েছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে উঠে এসেছে সহিংসতার নির্মম চিত্র। কোনো কোনো ভিডিওতে, মুসলিমদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হয়েছে। এক ভিডিওতে এক তরুণকে নির্মমভাবে মারধর করছে দলবদ্ধ হিন্দুত্ববাদীরা। আতঙ্কিত মুসলিমরা নিজঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন।

সহিংসতা শুরুর তিন দিন ও ২০ প্রাণহানীর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো শান্তির আহ্বান জানান। হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভ’তি প্রকাশ করেন। দিল্লির ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টির (এএপি) বিরুদ্ধের যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে। অনেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিল্লি পুলিশের চরম ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলেছেন। পুরো ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ এই বাহিনী। অভিযোগ ওঠেছে, বিরোধীদলগুলোর প্রতিও। তারা এই উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সবশেষে, দাঙ্গাকারীরা দায়মুক্তি নিয়ে সহিংসতা চালিয়ে গেছে। তাদের হামলার শিকারদের নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

দিল্লির এই দাঙ্গার সঙ্গে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস দুটি দাঙ্গার তুলনা টানা হয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত নয়। ১৯৮৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে তার দেহরক্ষীরা। এ ঘটনায় শিখদের বিরুদ্ধে তীব্র দাঙ্গা শুরু হয়। প্রায় ৩ হাজার শিখকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে চলতি শতকের শুরুতে, ২০০২ সালে গুজরাটে এক ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৭০ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে হত্যা করা হয় এক হাজারের বেশি মানুষকে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। সে সময় রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯৮৪ ও ২০০২ সালের দাঙ্গায় হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশ জড়িতে থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের হয়েছে। আদালত বলেছেন, তাদের পর্যবেক্ষণে ১৯৮৪’র পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া যাবে না।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ক অধ্যাপক আশুতোষ বার্শনি ভারতে ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার করেছেন। তার বিশ্বাস, দিল্লির দাঙ্গা অনেকটা ১৯৮৪ ও ২০০২ সালের ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার’ মতো রুপ নিচ্ছে। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তখনই হয়, যখন পুলিশ তা থামাতে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে না, উল্টো হামলাকারীদের সাহায্য করে। দিল্লির সহিংসতায় পুলিশের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত তিনদিনই। আশুতোষ বলেন, অবশ্যই এই সহিংসতা এখনো ১৯৮৪ বা ২০০২ সালের দাঙ্গার সমপর্যায়ে পৌঁছায়নি। এই মুহূর্তে আমাদের উচিৎ এটি প্রশমনে মনোযোগ দেয়া।

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ভানু যোশি ও গবেষকদের একটি দল ফেব্রুয়ারির বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিল্লির আসনগুলো পরিদর্শন করেন। তারা তাদের পরিদর্শনে খুঁজে পান, বিজেপি প্রতিনিয়ত সন্দেহ, সামাজিক কুসংস্কার ও প্যারানয়ার বার্তা ছড়িয়ে দলীয় কর্মীদের সক্রিয় করে তুলেছে। এক শহরতলীতে যোশি ও গবেষকদের দল বিজেপির এক কাউন্সেলরকে বক্তৃতা দিতে শোনে। ওই কাউন্সেলর ভোটারদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘আপনারা ও আপনাদের সন্তানরা স্থিতিশীল চাকরি, অর্থ পাবেন। তো ফ্রি, ফ্রি পাওয়ার চিন্তা বাদ দিন।’ রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার তাদের বিমামূল্যে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। ওই বিজেপি কাউন্সেলর তার বক্তৃতায় সেসব বিনামূল্যে পাওয়ার চিন্তা বাদ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। বিজেপি কাউন্সেলর আরো বলেন, এই দেশই যদি না থাকে, তাহলে সব ‘ফ্রি’ ফুরিয়ে যাবে।

যোশি ওই কাউন্সেলরের বক্তৃতার প্রসঙ্গে বলেন, ভারত এখন সবচেয়ে নিরাপদ রয়েছে। এমন অবস্থায়, দেশের নিরাপত্তা নিয়ে এমন প্যারানয়া ছড়ানোয় বিদ্যমান জাতিগত বিভেদ আরো বৃদ্ধি করে ও মানুষকে সন্দেহজনক করে তোলে।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মোদির দল জাতিগত মেরুকরণের প্রচারণা চালিয়েছে। সিএএ, কাশ্মীরের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রত্যাহার, বিশাল হিন্দু মন্দির স্থাপনা ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। বিজেপি দলনেতারা প্রায়ই বিদ্বেষপ্রসূত বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। প্রচারণায় এমন বক্তৃতা দেয়ায় দলটির একাধিক নেতাকে ভর্ৎসনা করেছে নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ। শাহিনবাগে মুসলিম নারীদের নেতৃত্বে সিএএ বিরোধী বড় ধরনের বিক্ষোভ চলছে। বিজেপি নেতারা বিশেষ করে ওই শহরতলীকে টার্গেট করে প্রচারণা চালিয়েছিল। বিক্ষোভকারীদের ‘প্রতারক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। যোশি বলেন, এমন নির্বাচনি প্রচারণার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেশজুড়ে চলমান সন্দেহ ও বিদ্বেষকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

দিল্লির ভক্সগুর স্থিতিশীল অবস্থা কেঁপে উঠা কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। রোববার বিজেপির এক নেতা, কপিশ শর্মা আইনভঙ্গ করে হুমকি দেন। দিল্লি পুলিশকে বলেন, যেসব জায়গায় সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে সেগুলো খালি করার জন্য তাদের হাতে তিনদিন সময় রয়েছে। তা না হলে, এর পরিণতি ভালো হবে না। দিল্লি সহিংসতার সূত্রপাত হয় সেদিনই। সেখান থেকেই শুরু হয় ভয়াবহ এই দাঙ্গার।

(মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিবিসির ভারত প্রতিবেদক সৌতিক বিশ্বাস।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status