শেষের পাতা

টিআইবি’র গবেষণা

দুদক ক্ষমতাসীনদের প্রতি নমনীয় বিরোধীদের হয়রানি

স্টাফ রিপোর্টার

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। ক্ষমতাসীনদের প্রতি সংস্থাটির নমনীয় মনোভাব এবং বিরোধীদের হয়রানি করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)’র এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে মাইডাস সেন্টারে আয়োজিতএক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের উপর করা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের গ্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের ক্ষমতা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী দলের রাজনীতিকদের হয়রানি করা এবং ক্ষমতাসীন দল-জোটের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে দুদকের বিরুদ্ধে। টিআইবি জানায়, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে।  গবেষণায় দুদকের ৫০টি নির্দেশক বিবেচনায় নেয়া হয়। এর মধ্যে ২১টিতে দুদক উচ্চ শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। ১৮টি মধ্যম ও ১১টি নিম্ন শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের এই নির্দেশক সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিরোধমূলক, শিক্ষামূলক ও আউটরিচ কার্যক্রমে দুদক সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে।

এরপর বেশি নম্বর পেয়েছে স্বাধীনতা ও মর্যাদা নির্দেশকে। স্বাধীনতার প্রশ্নে বলা হয়েছে, দুদক সরকারবিরোধীদের ওপর হয়রানিমূলক কাজ করে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের প্রতি সংস্থাটি নমনীয়। সবচেয়ে কম নম্বর পাওয়া দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে টিআইবি বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৪৭ হাজার ৫৪৯টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৩২০৯টি অনুসন্ধানের জন্য  আমলে নেয় দুদক। যার হার মাত্র ৬.৭৫ শতাংশ। যদিও দুদকের মতে অধিকাংশ অভিযোগ দুদক তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না। গবেষণায় অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের অনৈতিক চর্চা ও দায়িত্বে অবহেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া আইনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় নেয়া, মামলা দায়ের ও শাস্তির হার বিবেচনায় দুর্নীতির অনুসন্ধান এবং তদন্ত এখনও মানসম্মতভাবে দক্ষ ও পেশাদার নয় বলেও বলা হয় ফলাফলে। দুদকের কর্মক্ষমতার প্রশ্নে বলা হয়েছে- সংস্থাটির ওপর জনসাধারণের আস্থার ঘাটতি রয়েছে। জনগণের ধারণায় দুদক ক্ষুদ্র দুর্নীতির ওপর বেশি মনযোগী বড় দুর্নীতিবাজ ধরার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সাফল্য নেই। দুই বছরে মামলার হারও খুব কম বলে দাবি করা হয়েছে টিআইবির গবেষণায়। এতে উল্লেখ করা হয়, দুই বছরে ৪০৩৮টি অনুসন্ধানের মধ্যে ৮৪৮টি মামলা করে দুদক। যার হার মাত্র ২১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এ হার ৭৫ শতাংশের বেশি হয়।

টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী প্রতিরোধ, শিক্ষা ও আউটরিচ কার্যক্রমের জন্য কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুদক এবং সততা সংঘগুলোর মাধ্যমে গৃহীত কার্যক্রমগুলো এখনো মূলত: উপলক্ষভিত্তিক (যেমন আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস ও দুর্নীতি দমন সপ্তাহ পালন করা) এবং আনুষ্ঠানিক। এছাড়া দুদকের পাঁচবছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় (২০১৭ থেকে ২০২১) প্রতিরোধমূলক ও শিক্ষামূলক কৌশল অনুসৃত হয়নি, এবং দুদকের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম স্থানীয় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি পর্যায়ের ওপর নির্ভরশীল। দুদকের নিজস্ব গবেষণা শাখা গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ২০১৮ সালে দুদক প্রথমবারের মতো তিনটি গবেষণা আউটসোর্সিং- এর মাধ্যমে পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও এখনো এ সকল গবেষণা প্রকাশিত হয়নি।

অন্যদিকে, সহযোগিতা এবং বাহ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রান্তিক জনগণকে (বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী) সেবা প্রদানের জন্য দুদকের কোনো লক্ষ্য, কৌশল ও মানদণ্ড নেই। এছাড়া, দুদক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যভেদে কোনো প্রকার তথ্যও সংগ্রহ করে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে ‘শূন্য সহনশীলতা’র ওপর জোর দেয়া হলেও সরকারের কোনো কোনো উদ্যোগের মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যেমন ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’- এ সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, দুদক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত হয় বলে ধারণা রয়েছে। অপরদিকে, দুদক ও অন্যান্য দেশের দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত সহযোগিতা রয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীলতা নীতিকে সাধুবাদ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটির সুফল দেশবাসী পেতে চায়, কিন্তু এর বাস্তবায়নের এখতিয়ার যাদের তার মধ্যে অন্যতম দুদক, সেই প্রতিষ্ঠানটিকেই অকার্যকর করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর মধ্যে একটি ধারা সংযুক্ত করে এক ধরনের বার্তা দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে দুদকের আইনগত ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মানি লন্ডারিং-এর ক্ষেত্রে দুদকের আওতা বহির্ভূত করা হয়েছে। এছাড়া, ব্যক্তিমালিকানধীন খাত এখনও দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত। এ বিষয়সমূহ সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতির পরিচায়ক। অন্যদিকে, দুদকের মধ্যে এমন মানসিকতা দেখা যায়, যেন এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। যদিও সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু এটি যে স্বাধীনভাবে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে, সে ধরনের মানসিকতা ও প্রয়াস দুদকের মধ্যেও নেই, সরকারের পক্ষ থেকেও নেই। এ সব কারণে উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়না।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের না ধরে, ছোটখাটো দুর্নীতি নিয়েই দুদকের কার্যক্রম চলে। আর বড় ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুদকের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সেক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রীতার পরিচয় দেখা যায়। প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এরপর তাদের আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। তিনি আরো বলেন, দুদক কাগজে কলমে স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হয় না বলে মনে হয়।

টিআইবির প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে, দুদক কোনো অভিযোগে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পূর্বানুমতি নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা শুনেছি, এই চাকরি নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে ও দুদকও সক্ষমতার ঘাটতির পরিচয় দিয়েছে। এ নীতি বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক।

দুদকের ক্ষমতা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয় জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিরোধীদলের রাজনীতিকদের হয়রানি করা এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয়তা দেখায় দুদক। মোটকথা রাজনৈতিকভাবে দুদক প্রভাবিত হয় এবং নিজেকে প্রভাবিত করে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দুদকের ওপর এসব নিয়ে চাপ সৃষ্টি হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status