দেশ বিদেশ

ভালোবাসা কি কেবল মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ?

মানবজমিন ডেস্ক

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ৭:১৪ পূর্বাহ্ন

 ভালোবাসা, অন্তত আবেগাপ্লুত রোমান্টিক ভালোবাসার সারমর্ম ব্যাকরণেই প্রকাশ পেয়েছে। আমরা প্রেমে ‘পড়ি’, এতে ঘুরে বেড়াই না। একেবারে পা উপরে, মাথা নিচে পড়ার মতোই পড়ি। পা টেনে টেনে এগিয়ে যাই না। কখনো প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলি, ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে সতর্ক নীরিক্ষার মাধ্যমে যাচাই করি না। আমরা প্রেমে পড়ি উন্মাদের মতো- প্রিয় মানুষের গুণের যৌক্তিক মূল্যায়ন করে না, তাদের দোষ ভুলে অন্ধ হয়ে পড়ি।
রোমান্টিক ভালোবাসা অপ্রতিরোধ্য, দুর্নিবার। আমরা এই অনুভূতিকে যতোটা না নিয়ন্ত্রণ করি, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। এর রহস্য নিজেই বিশুদ্ধ সরলতার এক উদাহরণ। এর ধারা নিশ্চিতভাবেই অনুমেয় ও অনিবার্য। বিশ্বজুড়ে যেকোন সময়ে সাংস্কৃতিকভাবে এর বহিঃপ্রকাশ একইরকম। কিন্তু এসকল টগবগ করা স্বৈর্গিক অনুভূতি কেবল মস্তিষ্কের ভেতরে কিছু রাসায়নিক পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় হয়ে থাকে, এটা মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে ছড়িয়ে থাকে কল্পকাহিনীতেও তেমনটাই ফুটে ওঠেছে- কিউপিডের তীর, কোনো জাদুকরের তৈরি বিশেষ পানীয়ের কথাই ভাবুন।

তা সত্ত্বেও বিজ্ঞান ভালোবাসাকে পুরোপুরি বুঝতে ও বোঝাতে পারেনি। বন্ধন হরমোন হিসেবে পরিচিত নিউরোপেপটাইড অক্সিটোসিন। এটি সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে পাওয়া যায়। সমপর্কের বন্ধন তৈরিতে এর ভূমিকা রয়েছে। রাগমোচন বা আলিঙ্গনের মতো ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোয় এটি নির্গত হয়। ফলে ভালোবাসার হরমোন হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে। ভালোবাসার রাসায়নিক প্রক্রিয়া বুঝতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এর ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। এটি নির্গমন বন্ধ করে দিলে আবেগীয় বহিঃপ্রকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বেশি পরিমাণে নির্গত হলে একগামি প্রাণীও বহুগামিতার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এর প্রভাব অতোটা নাটকীয় নয়। এতে নতুন কোনো মানুষের চেয়ে পরিচিত মানুষের প্রতি রোমান্টিক অনুভূতি তীব্র হয়ে থাকে। সে হিসেবে অক্সিটোসিন নিশ্চিতভাবেই ভালোবাসার জন্য আবশ্যক না।

অবশ্য এমন কোনো পদার্থ আবিষ্কৃত হলেও, তা মস্তিষ্কে সাড়া জাগানিয়া হতে হবে। তো মস্তিষ্কের এই চিঠির বাক্সটি কোথায় অবস্থিত? কিভাবে সেই ‘বিশেষ একজন’ এর পরিচয় নিশ্চিত হয় মস্তিষ্ক? রোমান্টিক ভালোবাসার সময় মস্তিষ্কের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যে অংশটুকু জ্বলে ওঠে সেগুলোর সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও পুরষ্কৃত হওয়ার মুহূর্তের মিল পাওয়া যায়। ভালোবাসার পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে যে, রোমান্টিক ভালোবাসা ও মাতৃত্বের সম্পর্কের মধ্যে বা প্রিয় ফুটবল দলের জন্য ভালোবাসার মধ্যে খুব একটা ভিন্নতা নেই। ভালোবাসায় সেই উড়ে বেড়ানোর অনুভূতির ব্যাখ্যা আজও নিশ্চিতভাবে দিতে পারেনি নিউরোসায়েন্স।

ভালোবাসা জটিল, তীব্র অনুভূতি। এতে আক্ষেপের প্রকটতাও বেশি। সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই আমরা ভালোবাসি, যুক্তি থেকে নয়। কিন্তু মানুষ যদি যৌক্তিক আবেগহীন কারণেই ভালোবাসতো তা কেমন হতো? যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর ভিত্তি থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করতে হয় আমাদের। যাতে অন্যরা আমাদের সিদ্ধান্ত বুঝতে পারে ও আমাদের অবর্তমানে এটা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ভালোবাসার ভিত্তি আমাদের কারোই বুঝতে হয় না। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সাবজেক্ট অন্যকেউ চুরি করে নেয়ার কোনো রেসিপি কে চায়?

সহজাত প্রবৃত্তিকে আমাদের সতর্ক যুক্তির চেয়ে কম করে দেখারও কিছু নেই। সহজাত প্রবৃত্তির নীরব প্রক্রিয়া এটিকে যৌক্তিক চিন্তার চেয়ে আরো বাস্তবধর্মী করে তোলে। আমরা সচেতন মনে যত ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিতে পারতাম, তার চেয়ে বহু বেশি ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে। এর সত্যতা আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে- কোনো পরিচিত মুখ বর্ণনা করার চেয়ে, সেটা দেখে চিনতা পারাটাই সহজ নয় কি? ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এই চেনা কেন মূল্য পাবে না?
সবশেষে, ভালোবাসার নিউরাল কারবার যদি অতো সহজই হতো, তাহলে এতোদিনে কোনো ইনজেকশনের ভরেই তা অনুভব করা যেতো। কিন্তু জীববিজ্ঞানের শীতল, কঠিন যুক্তি তা অসম্ভব করে তুলেছে। ভালোবাসা যদি জটিল নাই হতো, তাহলে আমরা ভালোবাসায় বিবর্তিতই হতাম না। তা বললেও- অন্যান্য আবেগ, আচরণ, চিন্তার মতো ভালোবাসাও মস্তিষ্কের শারীরিক ক্রিয়ার উপর অবশ্যই নির্ভরশীল। বেশ জটিল সে ক্রিয়া। কিন্তু তাই বলে ভালোবাসা ‘শুধুই’ মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল বলাটা মানা যায় না। এমনটা বলার মানে হবে, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট ‘কেবল’ কিছু শব্দ। এতে মূল ভাবার্থটাই বাদ পড়ে যায়। শিল্পের মতো ভালোবাসাও মোট যোগফলের চেয়েও বেশিকিছু।
(বিবিসি অবলম্বনে)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status