প্রথম পাতা

টিআইবি’র রিপোর্ট

রাজউক ও দুর্নীতি সমার্থক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

৩০ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:১৯ পূর্বাহ্ন

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আর দুর্নীতি একাকার, সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। রাজউক একটি মুনাফা অর্জনকারী ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে, জনবান্ধব হতে পারেনি। ঘুষ ছাড়া কোনো সাধারণ নাগরিকের সেবা পাওয়া বিরল ঘটনা। যেমন ইমারতের নকশা অনুমোদনে ৫০ হাজার থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। তারা রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। তবে রাজউকের সব কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক): সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজউক থেকে বিনা ঘুষে সাধারণ মানুষ সেবা পেয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতাদের একাংশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে ঘুষ নেয়া হয়। রাজউক ও দুর্নীতি একাকার এবং সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজউক এতদিনেও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। এমনকি রাজউক নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠানও নয়। রাজউকের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যে দায়িত্ব অর্পিত, তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ড্যাপ ও ডিএমডিপি রক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাজউক এখন তার মূল ভূমিকা থেকেই সরে গেছে।

তিনি বলেন, রাজউকে দুর্নীতি, অপব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার প্রতিষ্ঠানকে আবার নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে গোড়া থেকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল। সেটিই অনিয়ন্ত্রণ, অব্যবস্থাপনা, নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন ও রক্ষককে ভক্ষকের ভূমিকায় রূপান্তরিত করার জায়গাটি তৈরি করেছে। অর্থাৎ তারা রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। বলা যায়, এই ধারণা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অথচ রাজউকের দায়িত্ব হলো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা।

রাজউকের সমালোচনা করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজউকের গোড়ায় গলদ রয়েছে। এতে করে অনিয়ম, দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। এমনকি তাদের কর্মকাণ্ডে কোনো জবাবদিহিতা নেই। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি করা হচ্ছে। আমাদের চাওয়া রাজউক যেন সত্যিকার অর্থেই একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হয়, যারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট খাতে এ গবেষণা চালায় টিআইবি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে নকশা অনুমোদনে ৫০ হাজার থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা টাকা পর্যন্ত রাজউক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়।

আবার ১০ তলার বেশি ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফি-র অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা এবং বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ১৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, ব্যক্তি পর্যায়ে রাস্তা প্রসস্ত দেখাতে ২০-৩০ হাজার টাকা, ছাড়পত্র অনুমোদনে ১৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত রাজউক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়।

এতে বলা হয়, নথি রক্ষকের কাছ থেকে মালিক নিজে বা দালাল কর্তৃক প্লটের ফাইল দেখানোর ক্ষেত্রে কোনো ফি না থাকলেও ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, প্রকল্পের আবাসিক ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরে ফি না থাকলেও ২ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় সেবাগ্রহীতাকে।

লিজ দলিলে ৩১ হাজার থেকে ৬০ হাজার পর্যন্ত নির্ধারিত ফি থাকলেও ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। নামজারি প্লট প্রতি নির্ধারিত ফি এর চেয়ে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, হেবা ফ্ল্যাট প্রতি ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা, বিক্রয় অনুমোদন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ আদান-প্রদান করা হয়।

বিল উত্তোলনে ফি না থাকলেও কার্যাদেশ মূল্যের ২ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া রাজউকে নবম থেকে বিশতম গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল নিয়োগের কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগসহ ব্যাপক ঘুষ আদায় করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে টিআইবি। এছাড়া নকশা অনুমোদনে সময়ক্ষেপণ, সেবায় প্রতারণা ও হয়রানি, পরিদর্শনে অনিয়ম ও দুর্নীতি, নকশা বাস্তবায়নে আইন ও বিধির লঙ্ঘন, প্লট বরাদ্দ, প্লট হস্তান্তর, ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরসহ একাধিক সেবায় ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না।

এতে আরো বলা হয়, প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে কারিগরি পদে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয় না। পছন্দনীয় স্থান বা পদে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩০ হাজার থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত নিয়ম-বহির্ভূতভাবে লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণা পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণমূলক কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়নমূলক কাজে অধিক গুরুত্বারোপ এবং আবাসন ও রিয়েল স্টেট ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফাকে প্রাধান্য দেয় রাজউক। অন্যদিকে, পরিকল্পনা প্রণয়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও তা বারবার উপেক্ষিত থাকে।

টিআইবির পক্ষ থেকে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের পৃথক একটি সংস্থা গড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ সংস্থাটির মতে রাজউক যেহেতু মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই তাকে এ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন।

এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনো ব্যক্তির দুর্নীতি প্রকাশ করা টিআইবির দায়িত্ব নয়। এটি রাষ্ট্র তথা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। রাজউকের দুর্নীতি রোধে এখনই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য আইন, প্রাতিষ্ঠনিক সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচার সংক্রান্ত ১৪দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এগুলো হলো- আইন ও বিধিমালার সময়োপযোগী সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি যুগোপযোগী ও সমন্বিত আইন প্রণয়ন করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতে রাজউকের সেবা কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে এবং দালাল কর্তৃক হয়রানি বন্ধ করতে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্তভাবেপুনর্গঠন করে রাজউকের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কমিটিকে কার্যকর করতে হবে। দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে ইত্যাদি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status