শেষের পাতা

ব্যাংকের সাড়ে তিন কোটি টাকা জুয়ায় উড়িয়েছেন কর্মকর্তা!

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে

৩০ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:০২ পূর্বাহ্ন

‘ভল্টটা ঠিক আমার ডেস্কের পাশে ছিল। সেখানে সবসময় ১৫ কোটি টাকা ক্যাশ থাকতো। খাতা-কলমে টাকার হিসাবও আমিই রাখতাম। তবে খেয়াল করলাম- কেউ ভল্টের টাকার ব্যাপারে আগ্রহ কিংবা খোঁজ রাখে না। সবার অগোচরে একদিন ভল্টের সামনের লাইন ঠিক রেখে পেছনের দিক থেকে দু’বান্ডিল টাকা সরিয়েছিলাম। দেখলাম- সেটা কেউ টের পায়নি। এরপরে বিভিন্ন সময়ে সাড়ে তিন কোটি টাকার 
মতো নিয়েছি।’ রিমান্ডে পুলিশের কাছে এভাবে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা সরানোর সূত্রপাতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন রাজশাহীর প্রিমিয়ার ব্যাংকের ক্যাশ ইনচার্জ শামসুল ইসলাম ওরফে ফয়সাল। তিনি নগরীর সাগরপাড়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে।
ফয়সালের বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভল্ট থেকে গত দুই বছরে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা চুরির অভিযোগ এনে গত ২৪শে জানুয়ারি নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ম্যানেজার সেলিম রেজা খান।
মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে গত ২৬শে জানুয়ারি আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে পুলিশ আসামি ফয়সালের রিমান্ড আবেদন করে। শুনানি শেষে বিচারক তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড শেষে গতকাল বুধবার বিকালে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে ব্যাংক কর্মকর্তা ফয়সাল ৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়েছেন। দুপুরে ফয়সালকে আদালতে পাঠানোর পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসা এসব তথ্য জানান নগরীর বোয়ালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।
ওসি বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর থানায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে শামসুল ইসলাম ফয়সাল শুধু টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে বিস্তারিত জানতে তাকে আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানিয়েছেন ফয়সাল। তবে ব্যাংক থেকে টাকা সরানোর ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য কারও যোগসাজশ ছিল না বলে দাবি করেছেন তিনি।’
ব্যাংক কর্মকর্তা ফয়সালের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নিবারণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ফয়সাল জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে তিনি ব্যাংকের টাকা সরাতে শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি যে টাকাগুলো চুরি করেছেন তা দিয়ে বাড়ির উচ্চমূল্যের সরঞ্জাম, সাংসারিক তৈজসপত্র ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা-খাওয়ায় শেষ করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘২০১৮ সালে বিপিএল এবং ২০১৯ সালের এপ্রিলে আইপিএল শুরু হলে স্ত্রী ও স্বজনদের নামে করা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে বাজি ধরা শুরু করেন। বিট৩৬৫-তে মূলত বাজি ধরতেন তিনি। পরে নগরীর বিভিন্ন স্থানেও ক্রিকেটকেন্দ্রিক জুয়ার আসরের খোঁজ পান তিনি। সেখানে ধারাবাহিকভাবে বাজি ধরে, কখনও জিতেছেন কখনও হেরেছেন। শেষ পর্যন্ত তার হাতে আর সেই টাকা থাকেনি।’
তার কাছ থেকে নগরীর কোনো জুয়ার আসর বা জুয়াড়ি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে কিনা প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘তিনি নির্দিষ্ট করে কোনো জুয়াড়ির তথ্য জানাতে পারেন নি। তার থেকে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তা খতিয়ে দেখে নগরীর জুয়ার আসরে জড়িত চক্রকে ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ।’
এদিকে, টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্তে এরইমধ্যে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্‌ আলমের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত টিম রাজশাহীতে পৌঁছেছে। বুধবার দুপুর থেকে তারা তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্‌ আলম বলেন, ‘এই টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ফয়সালের সঙ্গে আর কেউ আছে কিনা, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ ভোল্টে টাকা সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় অন্তত দু’জন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কথা। এক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করা হচ্ছে।’
দুপুরে প্রিমিয়ার ব্যাংকে গেলে কোনো কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। পরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা খান ব্যাংকে আসেন। বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়াধীন এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে জানিয়ে তিনি এড়িয়ে যান।
পরে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন থেকে তার কিছু কাজে আমাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি আমার কানে আসার পরপরই ২৪শে জানুয়ারি ব্যাংকের ভল্টের পুরো টাকা গণনা করা হয়। সেখানে প্রায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা কম পাওয়া যায়।’
ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আরো বলেন, ‘আগে থেকে সন্দেহের তালিকায় থাকায় আমরা তাকে ডেকে সিনিয়র কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। একপর্যায়ে তিনি জানান, টাকাগুলো তার দুই বন্ধুকে দিয়েছেন এবং নিজের একটি ব্যবসার কাজে লাগিয়েছেন। দ্রুত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু তা না পারায় আমি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করি। তারা আমাকে মামলা করার এবং তাকে পুলিশে দেয়ার নির্দেশ দেন।’
সিসিটিভির ফুটেজে বিষয়টি ধরা পড়েছে কিনা প্রশ্নে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করবো না। আমাদের কাছে যা তথ্য-প্রমাণ ছিল, তা পুলিশকে দিয়েছি। তারা বিষয়টি তদন্ত করে আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান করবেন।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status