প্রথম পাতা

নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা

শুভ্র দেব

২৮ জানুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন

সিটি নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা মনে করছেন, নির্বাচনী উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। ইতিমধ্যে রোববার টিকাটুলির সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের সামনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর     নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। সংঘর্ষের সময় অন্তত ৮/১০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখন পর্যন্ত সেই অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করতে পারেনি। গোয়েন্দা তথ্যমতে, নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসবে সংঘর্ষের ঘটনা ততই বাড়বে। বেশ কিছু প্রার্থী ছোট বড় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যারা বিভিন্ন সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে তারা এসব আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন। সারা দেশের অস্ত্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন লেভেলের সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অস্ত্র ব্যবহার করে এবং নির্বাচনের সময় সহিংসতার সৃষ্টি করতে পারে এমন সন্ত্রাসীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকার বাইরের সন্ত্রাসীরা ঢাকায় এসে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখছেন গোয়েন্দারা।  

এদিকে, ঢাকা সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার লক্ষ্য ৩০শে জানুয়ারি ভোর থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত সব ধরনের বৈধ অস্ত্র বহন ও প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উপসচিব আব্দুল জলিল স্বাক্ষরিত জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা-৬ থেকে জারি করা পরিপত্রের এক আদেশে বলা হয়েছে, ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৭(ক)(১) ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে বৈধ অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধের আদেশ জারি করা হয়েছে। আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্রমতে, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাসী মহল তৎপর হয়ে উঠেছে। ছোটখাটো সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক ও কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছেন। তারা তাদের বলয়ের প্রার্থীদের জয়ী করতে মরিয়া। আড়ালে আবডালে থেকে সহযোগীদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকার তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দীদের ভয়ভীতি হুমকি ধমকি দিচ্ছেন। অনেক সন্ত্রাসী প্রচারণা চালাতে বিদেশ থেকে এসেছেন। প্রকাশ্যে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর বাইরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। সূত্র বলছে, এবারের নির্বাচনে একাধিক অভিযুক্ত প্রার্থীরা পেশি শক্তির প্রদর্শনের জন্য সন্ত্রাসী ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করবেন। সন্ত্রাসীদের অনেকেই ঢাকা ও সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের কাছে ক্ষুদে অস্ত্র থেকে ভারী অস্ত্রও আছে। দেশের অপরাধ জগতের সন্ত্রাসীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় বিষয়টিকে খুবই বিপদজ্জনক মনে করছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাই আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারে এমন সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের তালিকা করে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দক্ষিণ ও উত্তরের অভিযুক্ত কাউন্সিলরদের অনুগত সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন, সোহরাব হোসেন স্বপন, সরোয়ার হোসেন মনা, জাকির হোসেন, খায়রুল, উজ্জল ও রিমন, স্বপন, মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা, রানা, মোল্লা মো. আবু কাউসার, সারওয়ার হোসেন বাবু, জামান, মাকসুদ, আনিসুর রহমান, ওমর ফারুক, গোফরান গাজীসহ শতাধিক সদস্য। এদের মধ্যে মতিঝিলের শাহজাহানপুরের অংকুর, রিভি, রাজু, আজাহার, বাবু, জহির। এছাড়া পল্টনের হাবিবুল্লাহ, সুমন, সৈকত, আলাউদ্দিন, লিটন, ইরামিন ও কাজি, তুহিন মুন্সি, নবীর হোসেন শিকদার ও সাইফুল ইসলাম। বিএম ফরহাদ অংকুর, আরিফুল ইসলাম লাবলু, রামপুরার আলোচিত ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামী রইছ, শাহাদত হোসেন, কবির হোসেন, শাজাহানপুরের পোল্ট্রি রিপন, সেলিম, রিভি, রামপুরার রনি, মগবাজারের সজীব, আজহার বাবুসহ আরো অনেকে। সূত্রমতে মতিঝিল, শাহজাহানপুর, খিলগাঁওয়ের ভোটের মাঠে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে হত্যা মামলার পরোয়ানা নিয়ে কানাডা থেকে দেশে ফেরা সোহেল। সোহেলের বিরুদ্ধে এর আগে অভ্যন্তরীন কোন্দলের জের ধরে ছাত্রলীগের এক নেতার পায়ে গুলি করে হত্যা চেষ্টার পাশাাপাশি স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সোহেল মতিঝিল ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। এভাবে নির্বাচনের মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে শতাধিক অস্ত্রধারী ক্যাডার সক্রিয় রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে ভয়ঙ্কর একে-২২সহ বিপুল পরিমান ক্ষুদ্র অস্ত্র। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এসব ক্যাডার বাহিনীর তালিকা করে ধরার চেষ্টা করছে। এর বাইরে গোয়েন্দারা বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা করেন এমন ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন। তারা যাতে কোনভাবেই নির্বাচনকে ঘিরে তৎপর না হতে পারে। কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার টিম কিছুদিন আগে অন্তত আট জন্য বৈধ ব্যবসায়ীকে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা করার সময় হাতেনাতে আটক করেছেন। যারা বৈধ অস্ত্রকে কৌশলে অবৈধ অস্ত্র হিসাবে বিক্রি করেন। আটকের পর তাদের কাছ থেকে অনেক ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়েছেন। সিটিটিসির কর্মকর্তারা এসব তথ্যর ভিত্তিতে কাজ করছেন।  তারা সারা দেশের ৮৪ জন্য বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ছাড়াও বৈধ-অবৈধ অস্ত্র কেনা বেচা বা বহন করে তাদের বিষয়ে সার্বক্ষনিক খোঁজ রাখছেন।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকে ঘিরে দেশে অস্ত্র প্রবেশ করতে পারে এমন ৩০টি পয়েন্টকে শনাক্ত করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। পয়েন্টগুলো হচ্ছে, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি, যশোরের বেনাপোল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, সেন্টমার্টিন, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সুদারামপুর, ফেনী নোয়খালী, চাঁদপুর, আখাউড়া,  খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও সিলেট। এসব পয়েন্টের মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বেনাপোল ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে বেশি অস্ত্র দেশে প্রবেশ করে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব পয়েন্টগুলো নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করছেন।

এদিকে শনিবার রাতে ঢাকার লালবাগ থানার শেখ সাহেব বাজার রোড থেকে আগ্নেয়াস্ত্র গুলিসহ আশিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, সিটি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও সহিংসতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আনার চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তার ওই ব্যক্তি জানিয়েছে, সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার বিভিন্ন সন্ত্রাসীর জন্য বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র নিয়ে এসেছিলো। এগুলো নির্বাচনী সহিংসতার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিলো। কিন্তু ঢাকা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনে যাতে কেউ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। ইতোমধ্যে আমরা অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছি। আমাদের বেশ কয়েকটি টিম এখনও অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যারা অস্ত্রধারী, অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং বাইরে থেকে যারা ঢাকার সঙ্গে অস্ত্রের ব্যবসা করে তাদের সকলের ওপরই আমাদের নজরদারিতে রেখেছি। ঢাকায় যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং প্রার্থীদের সঙ্গে ক্যাডার প্রকৃতির যারা আছে তাদের ওপরও নজরদারি আছে। তিনি বলেন, নির্বাচনী উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন অপ্রীতিকর কিছু করতে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।

কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্র্যান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার টিমের অতিরিক্ত উপ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম মানবজমিনকে বলেন, সিটি নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকায় অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরা কাজ করছি। সারা দেশের অনেক বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী আছেন যারা বৈধ অস্ত্রের আড়ালে অবৈধ অস্ত্র বিক্রি করেন তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছি। এর আগে আমরা অনেক বৈধ ব্যবসায়ীকে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচার সময় গ্রেপ্তার করেছি। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status