বাংলারজমিন

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হরিণঘাটা-লালদিয়া

জাকির হোসেন খান, পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে

১৭ জানুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমির নাম হরিণঘাটা-লালদিয়া। প্রাকৃতির অকৃপণ রূপ-লাবণ্যে ঘেরা এই পাথরঘাটার পর্যটন শিল্প এনে দিতে পারে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের দক্ষিণের এই অঞ্চলটি যেন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের আঁচলে ঢাকা। যেখানে পর্যটকরা মুগ্ধ হন, প্রেমে পড়েন শীতল প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে। এখানকার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক শোভা অতি সহজে মুগ্ধ করে যে কাউকে।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার এ অন্যতম দর্শনীয় স্থানটিতে যেমন উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মোহনীয় দৃশ্য। আর অন্যদিকে অকৃত্রিম বনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা সবুজের সমারোহ। এ সৈকতে মানুষের উপস্থিতি অনেক কম বলে এখানে নানা প্রজাতির পাখির নির্বিঘ্ন বিচরণ চোখে পড়ে। এ ছাড়া সৈকতে ঘুরে বেড়ানো লাল কাঁকড়ার দলও প্রায়শই তৈরি করে দেখার মতো এক দৃশ্য।

বনাঞ্চলটি পাথরঘাটার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর, পায়রা পূর্বে বিষখালী আর পশ্চিমে বলেশ্বর নদের মোহনায় গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এ বন নানা গাছপালায় সমৃদ্ধ। কেওড়া, গরাণ, গেওয়া, ওড়া প্রভৃতি শ্বাসমূলীয় গাছ বনের প্রধান বৃক্ষ। এ ছাড়া বনে দেখা মেলে হরিণ, বানর, বনবিড়াল, গুইসাপ, মেছো বাঘ, ডোরা বাঘ, সজারু, শিয়াল, শুকর নানা প্রজাতির সরীসৃপসহ প্রায় ২০ প্রজাতির বন্য প্রাণী। বনে আছে অন্তত ৩৫ প্রজাতির পাখিসহ নানা প্রাণীকূল। হরেক রকমের পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর চারপাশ।

জানা গেছে, সুন্দরবনের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রজাতির মায়াবী চিত্রল হরিণের বিচরণস্থল হওয়ায় এই বনের নামকরণ হয়েছে হরিণঘাটা বনাঞ্চল। দৃষ্টিনন্দন ঘন বন আর সবুজে ছাওয়া এ বনের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করেছে লাল দিয়া, পদ্মা, লাঠিমারা পাশাপাশি সুবিশাল তিনটি সৈকত। সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকনের জন্য এর চেয়ে উপযোগী স্থান আর বুঝি নেই।

সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলকে ইকো টুরিজম হিসেবে গড়ে তুলতে দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জলবায়ু ট্রাস্টের তহবিলের আওতায় বনের ভেতর বন আর সাগরের বিশাল জলরাশি দর্শনের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ফুট ট্রেইল। আর এ ফুট ট্রেইল নির্মাণের কারণে বনের ভেতর এঁকেবেঁকে উঁচু পিলারের ওপর পায়ে চলা পথ দিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বনের প্রকৃতি ও সাগরতীর দর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। সাগরের কোল ঘেঁষা হরিণঘাটা বনের ভেতর নির্মাণাধীন ফুট ট্রেইল (বনের ভেতর পায়ে চলা সেতু আকৃতির পথ) হরিণঘাটা বনে দর্শনার্থীদের নিসর্গ মায়ায় টানছে। ফুট ট্রেইল নির্মাণের ফলে হরিণঘাটা বন আকর্ষণীয় পর্যটনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও বনের ভেতর বিশ্রামাগার ও গোলঘরসহ ৬০ ফুট মিটার উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে।

পাথরঘাটা বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৭ সাল থেকে বনবিভাগের সমপ্রসারণে নানা প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বনসৃজন শুরু করে। এর পরে ২০১৩-২০১৬ সালে এখানে ২০০ হেক্টর, এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় নতুন বন সৃজিত হয়। আবার সাগর তীরে লালদিয়া চড়ের নতুন বন সৃষ্টি হওয়ায় বনাঞ্চলের পরিধি ক্রমশ বেড়েই চলছে। বর্তমানে ৫ হাজার ২৬৯ একরজুড়ে দৃষ্টিনন্দন এ বনে প্রাকৃতিক কেওড়া ও গেওয়াসহ সৃজিত সুন্দরী ও ঝাউবন রয়েছে। একদিকে বিস্তীর্ণ সাগরের হাতছানি আর অন্যদিকে অকৃত্রিম বনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা সবুজের সমারোহ যেন দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এ বনাঞ্চলটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয় ২০১৫ সালে।

প্রকৃতির এই লীলায় সাজানো হরিণঘাটার বনে কর্মব্যস্ত মানুষেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু বিনোদনের জন্য ছুটে আসেন লালদিয়ার এই সমুদ্র পাড়ে। পর্যটকদের কাছ থেকে সরকারিভাবে আদায় করা হচ্ছে রাজস্ব। পর্যটকরা বলছেন, এখানে সুন্দরবনের আমেজ ও সমুদ্র পাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য সবাইকে মুগ্ধ করছে। সমুদ্রের বিশালতায় পর্যটকরা পাচ্ছেন অন্যরকম অনুভূতি। ঠিক তেমনটি রয়েছে নানা অভিযোগ। অনুন্নত রাস্তাঘাট দিয়ে অনেকটাই কষ্ট করে আসতে হয় পর্যটকদের। কোনো প্রশাসনিক নিরাপত্তা পায়নি বলে জানায় পর্যটকরা। নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। হরিণঘাটা থেকে লালদিয়া পর্যন্ত যাবার পায়ে হাঁটা সেতুটি হয়নি এখনো সম্পূর্ণ। যে কারণে পর্যটকদের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হচ্ছে মাছ শিকারের ছোট-ছোট নৌকায়। দ্রুত লালদিয়া সেতুটি করার দাবি পর্যটকদের।

হরিণঘাটায় অবস্থিত এই বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হলো বনের ভেতর সর্পিলাকারে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০-১২টি খাল। জোয়ারের সময় যখন খালগুলো পানিতে পরিপূর্ণ থাকে তখন ছোট ছোট নৌকায় করে উপভোগ করা যায় বনের মধ্যকার সবুজের সমারোহ। তবে এ বনাঞ্চল থেকে প্রতিদিনই উজাড় হচ্ছে কেওড়া, সুন্দরী, বাইনসহ নানা প্রজাতির গাছ। এখনই চুরি বন্ধ করতে না পারলে হুমকিতে পড়বে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র। এ সাগর পাড়ে দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন। এতে সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এলাকার মানুষ নানা সম্ভাবনার আশা খুঁজতে শুরু করেছেন। এই পর্যটন কেন্দ্রটিকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসী বুনছে স্বপ্নের জাল। তাই দ্রুত কাজ করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য উন্নত রাস্তাঘাট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বৃদ্ধি করার দাবি এলাকাবাসীর।

এ বিষয় বনবিভাগের পাথরঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, হরিণঘাটা বনাঞ্চলে ইকো-টুরিজম হিসেবে গড়ে তুলতে দর্শনার্থীদের স্বচ্ছন্দে চলাচলের জন্য বনের ভেতর আঁকাবাঁকা দু’হাজার ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই ফুট ট্রেইলসহ ওয়াচ টাওয়ার, বিশ্রামাগার ও গোল ঘর নির্মাণ করা হয়ছে। দর্শনার্থীরা ফুট ট্রেইল দিয়ে স্বচ্ছন্দে হরিণঘাটা বনের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাগর তীরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ পায়। এই বনাঞ্চলটি আস্তে-আস্তে বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মতো হরিণঘাটা ও লালদিয়ার চরটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে পর্যটকদের কাছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status